মৃত্যু একটি স্বাভাবিক সত্য। কোরআন বলে ‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত’। প্রতিটি জীবের জন্য মৃত্যু অবধারিত। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’। যেকোনো মৃত্যু শোকের ছায়া ফেলে। অস্বাভাবিক মৃত্যু অস্বাভাবিকভাবেই আমাদের হৃদয় ও মনকে ব্যথিত করে। কোনো কোনো মৃত্যু কোনো কোনো সময় হিমালয়ের চেয়ে ভারী মনে হয়। আছিয়ার মৃত্যু বাংলাদেশের মানুষের কাছে সে রকমই একটি শোকাবহ ঘটনা। আছিয়া বাংলাদেশের মানুষকে কাঁদিয়ে শব্দহীন কণ্ঠে বলে গেছে— ‘লজ্জা এই সমাজ, লজ্জা এই দেশ, লজ্জা এই জাতির’। মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিল। আর কতটা নিজে এই ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে। তা ভাষায় অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একটি রাজনৈতিক বিবৃতিতে বলা হয়, নিপীড়িত আছিয়ার ওপর চলা নির্যাতন এবং তার মৃত্যু রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার জন্য চরম লজ্জাজনক। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র গঠনের এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এই নির্মম ঘটনা হতাশাজনকও বটে। এতে আরো বলা হয়, ফ্যাসিবাদী আমলে প্রতিষ্ঠিত বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা বাংলাদেশে অবাধে ঘটেছে। জুলাই অভ্যুত্থান-উত্তর নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচার বিভাগকে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জোর দাবি জানাই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে শোকগাথা। হাজারো মানুষের ক্রন্দন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে প্রকাশিত প্রতিটি শব্দে শব্দে, বাক্যে ও বাণীতে। কেউ লিখেছেন, ‘আছিয়া মরিয়া প্রমাণ করিলো সে মরে নাই! সে বাঁচিয়াছে! আর আমাদের মারিয়া গিয়াছে।’ ‘আছিয়ার মৃত্যু শুধুই একটা মৃত্যু নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর, প্রতিটি নারীর আজীবনের অভিশাপ। প্রতিটি সুস্থ পুরুষের নিজের মেয়ের কাছে আমৃত্যু ছোট হয়ে থাকা।’ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ এই ভাষায়— এ শহরে আর কোনো কন্যার জন্ম না হোক। মাতৃহীন, ভগনিহীন, কন্যাহীন মরুভূমি হোক এ দেশে। কুলাঙ্গারের আবাদ হোক!
কতিপয় নরপশুর আচরণে স্তম্ভিত দেশ। মানুষ পশুদের সমর্থন করে না। কিন্তু পশু রাজত্বের উত্তরাধিকারকে বহন করতে হয়েছে দেড় দশক। তবে সেটুকুই সবটুকু নয়। আমাদের নিস্পৃহতা, নিষ্ক্রিয়তা, আধুনিকতা, অশ্লীলতা, অশালীনতা ও বিচারহীনতা অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সুতরাং ‘দিনে দিনে বাড়িয়াছে দেনা, শোধিতে হইবে ঋণ’। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনোকালেই এদের সমর্থক ছিল না। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের লালিত মূল্যবোধ, জীবনাচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। তাদের জীবন অনেকাংশেই ধর্মাশ্রিত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাদের লালিত বিশ্বাস ও জীবনবোধের সঙ্গে রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনা সম্পূরক হয়নি। বরং আরোপিত প্রতিবেশীর সংস্কৃতি, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ও বৈরী প্রচারণা সমাজের অটুট বন্ধনকে ক্রমেই হ্রাস করেছে। বিগত ৫০ বছরে প্রতিক্রিয়াশীলতার অপবাদে আলেম সমাজের গ্রামীণ কর্তৃত্ব নাকচ করা হয়েছে। এমনকি ফতোয়া দেওয়ার স্বাভাবিক অধিকার অস্বাভাবিকভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। তৃণমূলপর্যায়ের স্থানীয় শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, গ্রামগঞ্জে প্রবীণদের পরিবর্তে নবীনের শাসন কায়েম হয়েছে। নবীনের শাসনে দোষ নেই। কিন্তু দোষের কারণ হলো সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। এই সামাজিক অবক্ষয় রোধে নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন কোনো আদর্শ পরিবেশিত হয়নি। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুসৃত ধর্মকে আইনের ভাষায় ও শাসকের কথায় বিপরীত আদর্শ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গরিষ্ঠ মানুষের জীবনবোধকে বিতর্কিত করা হয়েছে। যে প্রত্যাশা ও প্রশান্তির জন্য লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে, তা অপূর্ণই থেকে গেছে। ২০২৪ সালের গণবিপ্লব অবধারিতভাবে এবং অনুচ্চারিতভাবে জনমনে গ্রোথিত জীবন বোধের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে।
সন্দেহ নেই মানুষ নফসের দাস। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি মানসচরিত্রে দুটি বিপরীত বিষয় বিদ্যমান। প্রথমটি মানুষকে সততার পথে, ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। আর সে চায় নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী শাসিত হতে। আল-কোরআনের বাণী এ রকম— ‘আর আল্লাহ চান তোমাদের তওবা কবুল করতে। আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারা চায়, তোমরা প্রবলভাবে (সত্য পথ থেকে) বিচ্যুত হও।’ (সুরা : আন নিসা ৪ : ২৭) আরো বলা হয়েছে, ‘আর আমি ইচ্ছা করলে ওই নিদর্শনাবলির মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চমর্যাদা দিতাম, কিন্তু সে পৃথিবীর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুকুরের মতো। যদি তার ওপর বোঝা চাপিয়ে দাও, তাহলে সে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে অথবা যদি তাকে ছেড়ে দাও, তাহলেও সে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে। এটা হচ্ছে সেই কওমের দৃষ্টান্ত, যারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছে। অতএব তুমি কাহিনি বর্ণনা করো, যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সুরা : আল আ’রাফ (৭ : ১৭৬) জিনা-ব্যভিচার সম্পর্কে আল-কোরআনে খুব কঠিনভাবে বিধিনিষেধ রয়েছে, বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেও না, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে বলা হয়েছে— ‘তোমরা কি জানো কোন জিনিসের কারণে অধিকাংশ লোক জাহান্নামে যাবে? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বলেন : দুটি ছিদ্রপথ— লজ্জাস্থান ও মুখ। অন্যদিকে কোনো জিনিসের কারণে অধিকাংশ লোক জান্নাতে যাবে? আল্লাহর ভয় ও উত্তম স্বভাবের কারণে।’ (সহিহ আল বোখারি) মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দের যে প্রতিযোগিতা আছে। পরিবেশ ও সমাজ ভালো বা মন্দের দিকে আহ্বান করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এতটাই নৈতিকভাবে অধঃপতিত হয়েছে, সর্বত্রই মন্দ লোকদের আর মন্দ স্বভাবের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। পুরো জাতির জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক চিত্র আর কী হতে পারে! ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পর নির্ভরশীল। ব্যক্তি যদি তার বাবা-মা তথা পরিবার থেকে, নিজস্ব পরিবেশ থেকে ভালোর শিক্ষা গ্রহণ করে, তাহলে সে নৈতিক জীবন গড়ে তোলে। আর যদি ব্যক্তি সর্বস্তরে মন্দের শিক্ষা পায়, তাহলে অনৈতিকতার মধ্যেই জীবনযাপন করে। এভাবে আইন যদি হয় নৈতিকতার পক্ষে, ব্যক্তির পক্ষে, তা অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিপরীত অর্থে আইন ও নৈতিকতা যদি হয় সঠিক, তাহলে ব্যক্তির মন্দ চরিত্রও খুঁজে নেয় বেঠিক পথ। তাই জিনা ব্যভিচারের মতো অন্যায়-অপকর্মকে প্রতিরোধ করার জন্য ব্যক্তির সংশোধন যেমন অনিবার্য, তেমনি সমাজের ন্যায়নিষ্ঠ পরিবর্তনও আবশ্যক। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের সমন্বয় করতে পারে।
আমাদের সমাজে দ্বৈধ আছে। সমাজের নিকৃষ্ট নেতৃত্বও বলবে না যে, চুরি করা মহাপুণ্যের কাজ। সমাজের এই ইতিবাচক বিষয়টি প্রাধান্য পাবে তখনই, যখন সৎ ও যোগ্যতর লোকরা সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। সমাজ ও রাষ্ট্র দৃশ্যত ‘দুষ্টের শাসন ও শিষ্টের পালন করে’। আইন যখন প্রণীত হয়, তখন সঠিক ভাষায় ও সঠিক প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন হয়। আমাদের দেশের নারীর মর্যাদা রক্ষণ তথা ধর্ষণবিরোধী যে আইনের আধিক্য রয়েছে। যার শুরু ১৮৬০। ব্রিটিশ প্রণীত আইনে ফাঁকফোকর রয়েছে। পাকিস্তান আমলে এর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে বিশেষ করে আওয়ামী আমলে ধর্ষণের মাত্রা যেমন বেড়েছে, তেমনি আইনের ঘোষণা বারবার এসেছে। ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের ঘোষণা লক্ষ করা যায়। ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধ আইন করা হয়। ২০২০ সালে নারী নির্যাতনবিরোধী আইনটি আরো কঠিন ও কঠোর করা হয়। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নির্ণীত হয়। এখন প্রক্রিয়া চলছে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার। শিশু আছিয়ার মৃত্যুর বিনিময়ে আইনের কঠোরতা, বিচারিক স্বচ্ছতা এবং হয়তো দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত হবে। এখন দেশে ১০১টি নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে গড়ে ১ হাজার ৫০০ মামলা বিচারাধীন। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন আরো ২০০ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়া যতই কঠিন ও কঠোর হোক, নারী এবং শিশুদের সুরক্ষা অনিশ্চিতই রয়ে যাবে।
আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও আইনগত বাস্তবতায় ধর্ষণের বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। দুদিন আগে পুলিশপ্রধান অর্থাৎ আইজি ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার না করার আবেদন জানিয়েছে। কোনো পরিবারে যখন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন তারা তা গোপন রাখতে চায়। কারণ লজ্জা। যে মেয়েটি নিগ্রহের শিকার হয়, তা জানাজানি হলে সে সামাজিক অবজ্ঞার শিকার হয়। তার বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর যদি কেউ সাহস করে মামলার ঝুঁকি নেয়— পুলিশ, ডাক্তার, উকিল ও বিচারক অতিক্রম করে তার বিচার পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রক্রিয়াটি এতটাই জটিল, কুটিল ও লজ্জার যে, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা সহজ নয়। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও আইন-আদালতের লোকদের গভীর চিন্তাভাবনা এবং গবেষণার অবকাশ রয়েছে। এই সামান্য পরিসরে বিষয়টির আলোচনা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। এ ছাড়া গ্রাম্য সালিসের নামে নারী নির্যাতনকে ধামাচাপা দেওয়ার গতানুগতিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে বিচারের নামে প্রহসন হয়। আত্মীয়তা, স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির আড়ালে অপরাধী অধরাই থেকে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ১৯৯৬-০১ আওয়ামী আমলে ঘটেছিল। সবাই জানেন, সেখানে সেঞ্চুরি করার ঔদ্ধত্য ঘোষিত হয়েছিল। পেন্ডোরার বক্সটি ওপেন হলে নোংরা সব ঘটনা বেরিয়ে আসে। লজ্জার কথা এই যে, সে আমলের আওয়ামী উপাচার্য ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের রক্ষা করার জন্য অনেক কায়দা-কানুন করেন। বিগত ১৫ বছরে এ দেশে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য ধর্ষিত হয়েছে। পথেঘাটে সোনার ছেলেরা এতটাই মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে যে নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হয়। প্রকাশ্যে অসংখ্য অপহরণ ও নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। এই মহামারি প্রতিরোধে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। আলেম-ওলামাদের যে ছিটেফোঁটা প্রতিবাদ ছিল, তা আওয়ামী আস্ফালনে হারিয়ে গেছে। উল্টো আলেমদেরই ধর্ষক প্রমাণ করার কারসাজি হয়েছে।
এ সময় এই জাতি এ ধরনের ভয়াবহ বাস্তবতা অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অনির্দিষ্টতা, আদর্শিক শূন্যতা, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র এবং অবশেষে নৈতিক দুর্বলতা আমাদের পেয়ে বসেছে। এই অসামাজিক মহামারির মোকাবিলায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে নৈতিক বিপ্লব ঘটাতে হবে। ঘরে ঘরে পুলিশ পাঠিয়ে এ অন্যায় প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কারো কাছে ‘আলাদিনের চেরাগ’ নেই যে সে বদলে দেবে সবকিছু। আমাদেরই বদলে যেতে হবে আর বদলে দিতে হবে।