বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এক দফার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে তরুণরা। সে সময় ঘরে বসে থাকতে পারেননি হাটহাজারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা যুবক মোহাম্মদ সায়েম। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন হাটহাজারী বাসস্টেশনে আন্দোলনে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। সেই একটা গুলি তার বড় হওয়ার স্বপ্ন চুরমার করে দেয়।
ফ্যাসিবাদী শাসন অবসানের ছয় মাস অতিবাহিত হলেও এখনো স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেন না সায়েম। দরিদ্র বাবার একমাত্র সন্তান সায়েমের পায়ে গুলির স্থানে জটিল অপারেশন করাতে প্রায় তিন লাখ টাকার প্রয়োজন। টাকার অভাবে জটিল অপারেশন করাতে না পারায় হাঁটুতে রড নিয়ে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে স্ট্রেস দিয়ে কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে তাকে। চিকিৎসা বাবদ এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। দুই লাখ টাকা সরকারি ও বেসরকারি সূত্র থেকে পাওয়া গেছে। এক লাখ টাকা ব্যুরো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়।
সায়েম জানালেন সেই ঘটনাবহুল দিনের কথা। তিনি বলেন, সারা দেশে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছে তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি । বন্ধুদের সঙ্গে হাটহাজারী বাসস্টেশনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৫ আগস্ট মনের টানেই যোগ দিতে যাই। গুলিটা আমার পকেটে থাকা মোবাইল ফোন ছিদ্র হয়ে হাঁটুর উপরে ঢুকে হাড় ভেঙে মাংস নিয়ে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি লাগার পর সড়কে পড়ে যাই। ব্যথায় জ্বলছিল আমার পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে।
তিনি বলেন, সঙ্গে থাকা বন্ধুরা আমাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক হাসপাতালে) নিয়ে যায়। সেখান থেকে ২৫ দিন পর চিকিৎসাশেষে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে আসার পর পুনরায় নগরীর একটি হাসপাতালে পায়ে বিদ্ধ গুলি বের করার পর চিকিৎসকরা জানান, পায়ের ক্ষত সারতে একটি জটিল অপারেশন করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন প্রায় তিন লাখ টাকা কিন্তু সে টাকা জোগাড় করার সাধ্য নেই আমার দরিদ্র পরিবারের। জটিল অপারেশনে ভালো পা থেকে হাড় কেটে গুলিবিদ্ধ পায়ে লাগাতে হবে। আবার অপারেশনে শতভাগ ভালো হবে পা সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ডাক্তাররা।
সায়েম হাটহাজারী উপজেলার মেখল ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামের মো. সিরাজ ও রাশেদা আকতার দম্পতির সন্তান। পরিবারের সহায়-সম্বল বলতে বসতঘরের জায়গাটুকু ছাড়া তেমন কিছুই নেই। তার বাবার আয়ও খুব অল্প। তিনি একটি প্রাইভেট ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড।
সায়েম বলেন, এইচএসসি সম্পন্ন করেছি, তবে টাকার অভাবে অনার্সে ভর্তি হতে পারিনি। সংসারে আয়ের জোগান দিতে বাজারে একটি দোকানে চাকরি করছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল অনার্সে ভর্তি হব, ধীরে ধীরে লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি করে বাবা, মা আর বোনের মুখে হাসি ফুটাবো কিন্তু আমার সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
তিনি বলেন, এখনো আমি স্বপ্ন দেখি আমি আবার সুস্থ হয়ে দুই পায়ে উঠে দাঁড়াব, হাঁটব। কিন্তু টাকার অভাবে আমার চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। আমি আমার স্বপ্ন পূরণে সরকার ও সবার সহযোগিতা চাই। আমি সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে চাই।
বাবা মো. সিরাজ বলেন, ‘আমার দুইটা মেয়ে একটা ছেলে। চাকরির টাকায় কোনো রকমে কষ্ট করে সংসার চালাই। অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছি। একমাত্র ছেলে সায়েমের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় সব স্বপ্ন ভেঙে দিল। এখন ওর চিকিৎসা চালাবো কীভাবে এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।’
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মা রাশেদা আকতার বলেন, ‘ছেলের পায়ে গুলি লাগার কথা শোনার পর মনে হয়েছিল যেন আসমান ভেঙে আমার মাথায় পড়েছে। অভাব অনটনের সংসারের দুরবস্থা। তার উপযুক্ত চিকিৎসা করানোর মতো কোনো টাকা-পয়সা সামর্থ্য আমাদের নাই। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস স্যারের প্রতি আবেদন তিনি যেন আমার ছেলেটারে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করে দেন।