জুমানা নায়িলাত শখ। ৫ জুন থেকে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলন যখন ক্রমে বিস্তার লাভ করছিল এবং রূপ নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে, তখন তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তিনি ৩০ জুন থেকে আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত নিয়মিত রাজপথে থেকেছেন।
শখ বলেন, এবারের আন্দোলনে সবাই আন্দোলনকারী। কেউ হয়তো রাজপথে নামতে পারেননি, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদে সরব থেকেছেন। আমার অনুপ্রেরণা, বাবা। আব্বু সবসময় বলতেন, ‘অন্যায়ের সঙ্গে কখনোই আপস নয়। সবসময় সত্যকে তুলে ধরতে শিখবে। হয় লড়ব, নয়তো মরব; কিন্তু কোনোরকম আপসে যাব না।’
শখ মনে করেন, এবারের আন্দোলনে সবচেয়ে ইতিবাচক ঘটনা হলো, মানুষের ঐক্য ও চেতনার উত্থান। উদাহরণস্বরূপ, যদি আন্দোলন শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে তাদের নেতৃত্ব, পরিকল্পনা ও দাবি আদায়ে সফলতা আন্দোলনের শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই ঐক্য ও চেতনা সমাজে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এবং পরিবর্তনের পথ সুগম করে।
অন্যদিকে নেতিবাচক দিকটি হলো, আন্দোলনে উসকানি বা বহিরাগতদের অংশগ্রহণের ফলে লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনগুলোয় অনেক সময় রাজনৈতিক বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রবেশের ফলে সহিংসতা তৈরি হয়। এতে আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় এবং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
শখ জানান, প্রথমে তিনি পরিবারকে না জানিয়েই অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ক্রমেই যখন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছিল, তখন তাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তার মা খুবই চিন্তিত ছিলেন তাকে নিয়ে। তবুও শখকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি সবসময় আপডেট দিয়ে তার মাকে চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন। এরপর তার মা কিংবা পরিবারের সবাই তাকে সমর্থন করেছিলেন।
শখ বলেন, ‘আগে মানুষ ভোটাধিকার নিয়ে এত সচেতন ছিলেন না। এখন তারা এ বিষয়ে ভীষণ সচেতন। একবার না বুঝে ভুল করেছেন ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতায় এনে—সে ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে, সে বিষয়ে দেশের মানুষ এখন সচেতন এবং আমি এই বিষয়টাকে সাধুবাদ জানাই।’
আত্মতৃপ্তি নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন বাকস্বাধীনতা ফিরে এসেছে। আগে সরকারকে নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনাও করা যেত না। এখন নিজেকে হালকা লাগে। মন খুলে কথা বলতে পারি। তবে মাথায় রাখতে হবে, কথার লাগামটাও যেন সঠিক সময়ে টানতে পারি।’
শখ আরও বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবেই নিষিদ্ধ সংগঠন মেনে নিতে পারছে না। তারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টায় আছে। তাই এ বিষয়ে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবারই সতর্ক থাকা উচিত। আমরা এখনো বিপদমুক্ত নই।’
‘যেকোনো আন্দোলনে পুরুষের মতো অনেক নারীরও অংশগ্রহণ বা অবদান থাকে, নারীরাও নেতৃত্ব দেন। নারীর এই নেতৃত্বকে সমাজ কীভাবে দেখে বলে মনে করেন?’—এ প্রশ্নের উত্তরে শখ বলেন, ‘নারী নেতৃত্বকে সমাজ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং তা অনেকাংশে সমাজের প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি এবং মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। সমাজের একটি অংশ নারীর নেতৃত্বকে ক্ষমতায়নের উদাহরণ হিসেবে দেখে। এটি প্রমাণ করে, নারীরা কেবল গৃহস্থালি কাজেই সীমাবদ্ধ নন, তারা সমাজ, রাজনীতি ও আন্দোলনে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সমাজে নারীর নেতৃত্বকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা শুরু হলেও বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পুরোপুরি দূর হয়নি। তবে আশার কথা, দিন দিন নারীর নেতৃত্বকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ও স্বাভাবিক হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে।’
শখ এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, যা সমতাভিত্তিক, উন্নত এবং সব নাগরিকের জন্য সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ, যা কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও পরিবেশগত উন্নয়নও নিশ্চিত করবে। নতুন বাংলাদেশ যেন একটি উদাহরণ হয়ে ওঠে, যেখানে মানুষ শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিয়ে বসবাস করতে পারে। এর ভিত্তি হতে হবে ঐক্য এবং ন্যায়বিচারের ওপর।
সবশেষে শখ বলেন, ‘দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিশেষ অনুরোধ—মনে রাখবেন আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলেই বাংলাদেশ। আমরা সবাই মিলেই আগামীর সম্ভাবনাময় সূর্য। যত কিছুই হোক না কেন, দেশ ও দশের প্রয়োজনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো ষড়যন্ত্র যেন আমাদের ঐক্য ভাঙতে না পারে।’