সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:১৭ অপরাহ্ন

খুনি হাসিনা আমার ছেলেটারে গুলি করে মারে ফেলল’

রিপোটারের নাম / ৫৩ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫

আব্দুল হাই, পাঁচবিবি (জয়পুরহাট)
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫, ১০: ১৭

জয়পুরহাটে ২০২৪ সালের বৈষ্যম্যবিরোধী আন্দোলন সফল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সর্বপ্রথম শহীদ হন পাঁচবিবি উপজেলার নজিবুল সরকার ওরফে বিশাল। উপজেলার নাকুরগাছি কারিগরি কলেজের শিক্ষার্থী বিশাল ধরঞ্জি ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের মজিদুল সরকার ও বুলবুলী খাতুন দম্পতির বড় ছেলে।

অত্যন্ত মেধাবী ও সুদর্শন বিশাল গ্রামের সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন। ছোট ভাই মোমিন পার্শ্ববর্তী রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। বাবা মজিদুল সরকার বৃদ্ধ বয়সেও দিনমজুরের কাজ করতেন। মা বুলবুলী খাতুন সংসারের কাজের পাশাপাশি ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে অভাবের সংসারে সহযোগিতা করতেন। অভাবের সংসারেও নিজের ছেলেদের বুকে আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু পুলিশের গুলিতে বড় ছেলে বিশাল শহীদ হন।

বিশালের কথা মনে করে এখনো অঝরে কাঁদেন মা। চোখের পানি মুছতে মুছতে বুলবুলী খাতুন বলেন, ‘খুনি হাসিনা আমার ছেলেটারে বাঁচতে দিল না বাবা, গুলি করে মারে ফেলল। আল্লাহ যেন খুনি হাসিনার বিচার করে।’

বন্ধুদের ভাষ্যমতে, বিশাল খুব সাহসী ছিলেন। মিছিলের সামনে থাকতে পছন্দ করতেন। ৪ আগস্টের গণমিছিলে বিশাল সামনে থেকে স্লোগান দিচ্ছিলেন। জয়পুরহাট শহরের প্রধান সড়কে পুলিশ মিছিলে বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে আন্দোলনকারীদের। একপর্যায়ে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। এ সময় পুলিশের গুলি সরাসরি বিশালের ডান পাঁজরে ঢুকে বাম পাঁজর দিয়ে কলিজার অংশবিশেষসহ বেরিয়ে যায়। বিশাল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বন্ধুরা বিশালকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎস মৃত ঘোষণা করেন।

বিশাল মিছিলে যাওয়ার সময় তার বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘আমার বাবা-মাকে দেখার জন্য ছোট একটা ভাই আছে। কোনো সমস্যা নেই, প্রয়োজনে শহীদ হব।’ বিশালের শহীদ হওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। ৪ আগস্ট রাত ১০টায় নিজ গ্রামে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যেও সহস্রাধিক মানুষ জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।

মা বুলবুলী খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলেটারে গ্রামের সবাই ভালোবাসত। জুলাই মাসে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে সকালে বের হয়ে যেত, ফিরত শেষবেলা। জিজ্ঞাসা করলে বলত, বন্ধুরা মিলে ঘুরতে গেছিলাম। পরে জেনেছিলাম ও মিছিল করতে যেত। ওর বন্ধুরা মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে একসঙ্গে মিছিলে যেত। আমি কিছুই জানতাম না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুলবুলী খাতুন বলেন, ‘আমি যদি একটু জানতে পারতাম, তাহলে বাবাকে (বিশালকে) যেতে দিতাম না।’

বিশালের শহীদ হওয়ার দিনের স্মৃতিচারণ করে মা বুলবুলী খাতুন বলেন, ‘সেই দিনটি ছিল ৪ আগস্ট রোববার। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরের মধ্যে এটা-সেটা করছিল বিশাল। কিন্তু কথাবার্তা তেমন বলছিল না। সকাল ৯টার দিকে আমাকে বলেÑ মা, আমাকে জয়পুরহাটে যেতে হবে। তোমার ওষুধটা আনা দরকার।’

আমি বললাম, ‘বাবা এই গণ্ডগোলের মধ্যে জয়পুরহাট না গেলেই কি নয়? জয়পুরহাটে এমন কী কাজ আছে তোর?’ কথাগুলো শুনে ও কেন জানি জেদ ধরে বললÑ না মা, আমাকে আজ জয়পুরহাট যেতেই হবে। ওরা (বন্ধুরা) সবাই অপেক্ষা করছে। এই বলে তাড়াহুড়া করে একটু খেয়ে সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় বাড়ির বাইরে ওর ছোট ভাইকে বলে যায়Ñ মোমিন, আমরা দাবি আদায়ের জন্য মিছিলে যাচ্ছিরে। এ দাবি সত্য প্রতিষ্ঠার, তুই বাবা-মার কাছে থাকিস, আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে বাবা-মাকে বলিস, তারা যেন ১০টা এতিমকে ডেকে এক সন্ধ্যা খাওয়ায়।’

কথাগুলো বলতে বলতে বুলবুলী খাতুন ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, ‘হায়! ওর কথাগুলো যদি আমি আগে জানতাম, তাহলে কি আর যেতে দিতাম? আমার মনটা সেদিন কেমন কেমন জানি করছিল। একটুও ভালো লাগছিল না, বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি, আমার ছেলেটা (বিশাল) কখন যে ফিরে আসে? শেষে বিশাল ঠিকই ফিরে এলো; কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে করে, লাশ হয়ে।’

বাবা মজিদুল সরকার আমার দেশকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ অথবা আহত হয়েছেন তাদের যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে খুনি হাসিনার যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। তাহলেই আমরা শান্তি পাব। আমার বিশালের আত্মা শান্তি পাবে। আর কিছু চাই না।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ