রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৪২ পূর্বাহ্ন

‘জাতির পিতা’ বিধান বিলুপ্তির সুপারিশ

রিপোটারের নাম / ৮৮ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩: ৫৪

বিদ্যমান সংবিধানের ‘জাতির পিতা’ বিধান বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে বাহাত্তরের সংবিধানে ফ্যাসিবাদের বীজ নিহিত থাকা এবং সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে মন্তব্য করেছে কমিশন।

শনিবার বিকালে প্রকাশিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়। পাঁচ খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ কমিশন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এর আগে সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সুপারিশ হস্তান্তর করে।

সংবিধানে ‘জাতির পিতা’ বিধান ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বাধ্যতামূলক করার বিধান বাতিলের সুপারিশ করে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের বিধান ব্যক্তি বন্দনাকে উৎসাহিত করে, স্বৈরতন্ত্রের পথ সুগম করে। ‘বাংলাদেশ’ অগণিত বরেণ্য মানুষের নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ ও অবদানের সামষ্টিক ফসল। এ রক্তস্নাত মাতৃভূমিতে একক ব্যক্তিকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে অভিহিত করার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি বা বাস্তবতা নেই।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ফ্যাসিবাদের বীজ রয়েছে জানিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রসঙ্গ টেনে সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বীজ ১৯৭২ সালের সংবিধানের মধ্যেই নিহিত ছিল। এরই ফল প্রতিটি আমলেই ক্ষমতার পুঞ্জীভবন আরো ঘনীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকতা আরো প্রকট রূপ পেয়েছে, বিচার বিভাগ ক্রমশ বেশি বেশি হারে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, জবাবদিহির অভাবে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক দুর্নীতি আরো প্রবল চেহারা নিয়েছে।’

১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সে ধারণা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বলে দাবি করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এটি ১৯৭০ সালের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ইশতেহার বা ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পাকিস্তানের খসড়া সংবিধানে উল্লিখিত ছিল না। কোনো প্রাক-সাংবিধানিক নথিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শাসননীতি হিসেবে গ্রহণ করার কোনো উল্লেখ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব রাজনৈতিক আলোচনায় ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল একপ্রকার অপরিচিত ধারণা। তবু কোনো অর্থবহ আলোচনা ছাড়াই ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার এ অন্তর্ভুক্তি দেশে বিভক্তি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে উল্লেখ করে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং অতীতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান বহুত্ববাদী সমাজের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং মূলত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিরোধী। সুতরাং রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’রয়েছে।

সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখার বিধান বহাল রাখার পক্ষে অভিমত দিয়ে সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিষয়ে অংশীজন ও কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। তাই কমিশন বিধানটি রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বিষয়টিতে কমিশনের সব সদস্যরা একমত হননি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ (আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু) অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মত দিয়েছে কমিশন।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি সংবিধানে বাংলাদেশে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত সব ভাষা এ দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

১৪৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যার মেয়াদ হবে চার বছর করে। এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতা হতে পারবেন না বলেও সুপারিশে বলা হয়।

আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ফলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে’বলা হয় এ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, এ কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে যেমন সম্প্রীতি নষ্ট করেছে, তেমনি ধ্বংস করেছে ভারসাম্য। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৫ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, সব নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকবে। অনুচ্ছেদ ৭০ প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের নেতা হিসেবে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সব দলীয় সদস্যকে ভোটের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে।

এতে আরো বলা হয়, হাইকোর্টের বিচারক এবং অধস্তন আদালতের নিয়োগদানও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি করেন। রাষ্ট্রপতি প্রায় সব কাজই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমের ওপর ন্যায়পালের মাধ্যমে কোনো তদারকির ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি। কার্যকর ভারসাম্যের অনুপস্থিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য একটি গুরুতর হুমকিস্বরূপ। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার এতো ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ তাকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে।

এদিকে কমিশন ‘যন্ত্রণা কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড’ সম্পর্কিত একটি স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা র সুপারিশ করেছে। ন্যায়পাল নিয়োগ বাধ্যবাধকতা, বিচার ও দণ্ডসংক্রান্ত অধিকারের ক্ষেত্রে অবিলম্বে অবহিত হওয়ার অধিকার, আইনগত প্রতিনিধিত্ব ও আইনগত সহায়তার অধিকার, সময়মতো বিচারের অধিকার, যৌক্তিক জামিনে মুক্তির অধিকার, এবং অসাংবিধানিক বা বেআইনি উপায়ে প্রাপ্ত প্রমাণ বাতিল করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। জনগণ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ সংবিধানে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, ব্যক্তি ও জনপরিসর উভয় ক্ষেত্রে নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিতকরণ, ভোক্তা-সুরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে স্পষ্টভাবে আদালতের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ ও আইনসভায় মানবাধিকার বিষয়ক স্থায়ী কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ