রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন

নিলামে উঠছে আওয়ামী মন্ত্রী-এমপিদের ৩০ গাড়ি

রিপোটারের নাম / ৬১ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ১১: ৫২

শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পলাতক মন্ত্রী-এমপিদের ২৪টি গাড়িসহ ৪৪টি গাড়ি গত ২৭ জানুয়ারি নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এর মধ্যে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি কেনার জন্য কোনো ক্রেতা আগ্রহ দেখাননি।

বাকি ১৫টি গাড়ির বিষয়ে দরপত্র পড়লেও চাহিদার তুলনায় তা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। ফলে প্রথম নিলামে বিলাসী গাড়িগুলোর একটিও ডেলিভারি করতে পারছে না কাস্টমস। ফলে দ্বিতীয় দফায় নিলামে উঠছে পলাতক মন্ত্রী-এমপিদের ৩০টিসহ ৬০ গাড়ি।

২০টি সাধারণ গাড়ি নিলামে উঠেছিল। তার মধ্যে ১৯টির ক্ষেত্রে নিলাম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আদালতে গেছেন আমদানিকারকরা। ফলে শেষ মুহূর্তে এসে ওই গাড়িগুলোও ক্রেতার অনুকূলে ডেলিভারি দিতে পারছে না কাস্টম হাউস।

গত ২৪ ডিসেম্বর নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে আসেন। তাকে জানানো হয়, নিলাম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত না করায় বন্দরের স্বাভাবিক অপারেশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা গাড়িগুলো বন্দর ইয়ার্ডের অনেক জায়গা দখল করে আছে। ফলে আমদানি-রপ্তানির চাপ বাড়লে জট তৈরি হচ্ছে বন্দরে। এ সময় তিনি পুরোনো গাড়ি ৩১ জানুয়ারির মধ্যে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করার নির্দেশনা দেন। মূলত এরপর থেকেই গতি পায় পড়ে থাকা গাড়ি নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া।

ওই নির্দেশনার পর বন্দরের ইয়ার্ডে কতটি পুরোনো গাড়ি পড়ে আছে, তার তালিকা প্রণয়ন করে কাস্টমস। পতিত সরকারের শেষ সময়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা সাবেক এমপি ও মন্ত্রীদের আটকে যাওয়া ৪৪টি বিলাসবহুল গাড়িও রয়েছে নিলাম পণ্যের তালিকায়। ইতোমধ্যে নিলামে তোলা হয়েছে বেশকিছু গাড়ি। আরেক দফায় নিলামে তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে এরই মধ্যে।

এই দফায় পলাতক এমপি-মন্ত্রীদের আগের ২৪টি গাড়ির সঙ্গে নতুন করে আরো ৬টি গাড়ি যুক্ত হচ্ছে। তবে এবারও ২০০২ সাল থেকে পড়ে থাকা ১৯৫টি গাড়ি নিলামে তোলা সম্ভব হয়নি মামলার কারণে। এসব গাড়ির মধ্যে প্রাইভেটকার, মাইক্রো, পাজেরো, পিকআপ ও ট্রাকও রয়েছে।

বন্দরের নিয়মানুযায়ী আমদানিকারকদের গাড়ি বন্দর শেডে নামার ৩০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নিতে হয়। এক্ষেত্রে কোনো আমদানিকারক তার গাড়ি ডেলিভারি না নিলে নিয়মানুযায়ী তা নিলাম করার জন্য কাস্টমসের কাছে কাগজ হস্তান্তর করে বন্দর। এরপর কাস্টমসের নিলাম শাখা গাড়িটির তৈরি সাল, মডেল, আমদানি সাল, আমদানিকারক দেশের মূল্য, বাংলাদেশের শুল্ক ও বন্দরের জরিমানাÑ সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করে। নির্ধারিত দামের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অর্জিত হলে প্রথম নিলামেই ক্রেতার কাছে গাড়ি হস্তান্তর করতে পারে কাস্টমস।

কোনো কারণে প্রথম নিলামে ৬০ শতাংশ অর্জিত না হলে পরবর্তী নিলামের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই নিলামে আগের নিলামের চেয়ে বেশি দাম উঠলে কাস্টমস যদি মনে করে উপযুক্ত দাম হয়েছে, তবে সেক্ষেত্রে ক্রেতার অনুকূলে গাড়ি ডেলিভারি দিতে পারে।

স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়ার কিছু জটিল দিকও রয়েছে। যেমন কোনো আমদানিকারক যদি গাড়ি ডেলিভারি হওয়ার আগ মুহূর্তে পর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হয়, তবে নিলামের মাধ্যমে গাড়ি বিক্রির এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া গাড়ির মূল্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করা হয় না মর্মে অভিযোগ রয়েছে। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ দাম নির্ধারণ করা হয় নিলামে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ৬০ শতাংশের কাছাকাছি বিট করলে তা প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। ফলে নিলামে আগ্রহ হারান সাধারণ ক্রেতারা।

গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বারবিডা’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক বাবর জানান, মূলত আইনি জটিলতার কারণেই নিলামের গাড়ি খালাস করা সম্ভব হয় না। মূল্য নির্ধারণের পর কাস্টমস যে রিজার্ভ ভ্যালু ধরে রাখে, সেখানে অস্পষ্টতা রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাস্টমসের রিজার্ভ ভ্যালু বাজারদর থেকে বেশি থাকে। ফলে নিলামে আগ্রহ হারান বিডাররা। এছাড়া কোনো গাড়ি যদি উৎপাদন সাল থেকে ৫ বছর অতিক্রম করে, তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিয়ারেন্স পারমিট নিতে হয় গ্রাহকের নিজ দায়িত্বেÑ যা অনেক জটিল প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কাস্টমসেরও কিছু করার থাকে না। সব মিলিয়ে নিলাম প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে হলে আইনের সংস্কার জরুরি।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন জানান, এখন যে নিলামগুলো হচ্ছে, সেগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আনা গাড়ি। যেমন, গত ২৭ জানুয়ারি সবশেষ অনুষ্ঠিত নিলাম কার্যক্রমে পলাতক মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসী গাড়ি ছাড়া আরো ২০টি সেডান কার ও পণ্য পরিবহন নিলামে তোলা হয়েছিল। ২০টি গাড়িই কাগজে-কলমে বিডাররা পেয়ে গেছে।

কিন্তু কাস্টমসের নিলাম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আমদানিকারকরা যথাযথ শুল্ক ও জরিমানা পরিশোধ করে গাড়ি খালাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আদালতে রিট করে। আদালত আমদানিকারকের অনুকূলে গাড়িগুলো ছাড় করার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশ আসার আগেই গাড়িগুলোর নিলাম হয়ে গেছে। তাই ক্রেতা যদি ফের আদালতে যায়, তাহলে এই গাড়ির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এমন ১৯৫টি গাড়ি বন্দরে পড়ে থাকতে থাকতে এখন অকেজো হয়ে গেছে।

তিনি আরো জানান, সম্প্রতি সাবেক সংসদ সদস্যদের আরো ছয়টি গাড়ি নিলামের উপযুক্ত হয়েছে। এসব গাড়িসহ আগের ২৪টি খুব শিগগিরই পুনরায় নিলামে তোলা হবে। এর বাইরে আরো ৩০টির মতো বিভিন্ন মডেলের গাড়ি আছে, যেগুলো নিলামের উপযুক্ত হয়েছে। সেগুলোও শিগগিরই নিলামে তোলা হবে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের মুখপাত্র ও উপকমিশনার সাইদুল ইসলাম জানান, বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কাস্টমস বরাবরই আন্তরিক। প্রতিমাসেই নিলামযোগ্য পণ্যের নিলাম কার্যক্রম আয়োজন করা হচ্ছে। কিন্তু আইনি জটিলতায় পণ্য ডেলিভারি কার্যক্রমে গতি আসছে না। গাড়ির ক্ষেত্রে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমদানিকারক কিংবা নিলামে অংশ নেওয়া কোনো এক পক্ষ আদালতে গেলে সেই মামলা আর নিষ্পত্তি হচ্ছে না।

এ কারণে ২০০২ সাল থেকে পুরোনো গাড়ির স্তুপ জমছে বন্দরে। আর এসব কারণে প্রকৃত ক্রেতারা নিলামে অংশ নিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বন্দরের জায়গাও খালি হচ্ছে না। তবে ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস যৌথভাবে পুরোনো এসব মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংকটের সমাধান হবে বলেও আশার কথা জানান তিনি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ