২০২৪ সালের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের গণআন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মুগদা থানা শ্রমিক দলের সদস্য ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. জালাল উদ্দিন। আন্দোলনের মাঝপথে ২০ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে রাজধানীর মুগদা থানার মানিকনগর বিশ্বরোড চৌরাস্তায় শহীদ হন তিনি।
৪১ বছর বয়সি শহীদ জালালের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদেরগঞ্জ থানার সখিপুর ইউনিয়নের আনু সরকারকান্দি গ্রামে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিতে হারিয়ে দুই শিশুসন্তান জিসান (১২) ও শিহাবের (৭) ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন শহীদ জালালের স্ত্রী মলি আক্তার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমার দেশকে মলি আক্তার বলেন, মাত্র আট বছর বয়সেই বাবাকে হারান জালাল উদ্দীন। ফলে অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাতেন। গ্রামের বাড়িতে জালালের নেই নিজের কোনো ঘর। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জালাল শহীদ হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন ও মানিকনগর বিএনপির সহায়তায় কোনোরকমে সংসার চলছে মলি আক্তারের।
বড় ছেলে সিজান মানিকনগর আইডিয়াল স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ছোট ছেলে পড়ে মাদরাসায়। মলি আক্তার বলেন, ‘আমার যত কষ্টই হোক না কেন, আমি আমার স্বামীর মনের আশা পূরণ করতে সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করব।’ এখন সরকারের কাছে তার দাবি, রাষ্ট্র যেন তার পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।
কোনো আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে মলি আক্তার বলেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছেন তারা। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টাকাগুলো ব্যাংকে রেখেছেন। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ এবং উপজেলা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন। এ ছাড়া মানিকনগর বিএনপির তরফ থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন বলে জানান মলি।
স্বামী সম্পর্কে মলি আক্তার জানান, বিয়ের পরপরই ঢাকার মানিকনগরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। যখন যে ব্যবসা পেতেন, সেটাই করতেন। পরে মানিকনগরে একটি দোকান দিয়েছিলেন জালাল। তবে সড়কের নির্মাণকাজের সময় দোকানটি ভেঙে ফেলতে হয়। এরপর আবারও শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। দোকানে দোকানে রসমালাই বিক্রি শুরু করেন। এভাবে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে যাওয়া শুরু করেন তার স্বামী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনিও প্রতিদিন যেতেন রাজপথে।
মলি আক্তার বলেন, ‘আমি কিছুতেই চাইতাম না সে আন্দোলনে যাক। আমি বাধা দিলে বলতÑ আমি যদি মরে যাই, তাহলে বিএনপির লোকেরা তোমাদের দেখবে। তুমি আমাকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিও না। কত মানুষ না খেয়ে থাকছে, আমরা তো তবুও খেতে পাই। আমরা সবাই ঘরে বসে থাকলে কি হবে? আমাদের আন্দোলনে যেতেই হবে, দেশকে স্বাধীন করতে হবে।’ এরপর থেকে মিছিল-মিটিংয়ে গেলে আমি তাকে আর বাধা দিতাম না।’
উত্তাল জুলাইয়ের ১৮ তারিখে আন্দোলনে গিয়ে মাথা ফেটে যায় জালালের। ১৯ জুলাই সকাল ১০টার দিকে বাজারে গিয়ে ফল ও তরকারি কিনে আনেন। মাগরিবের নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। কিন্তু নামাজ শেষে বাসায় না এসে মানিকনগর বিশ্বরোডে চলে যান জালাল। মলি আক্তার আরো জানান, ‘অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ায় কোথায় আছে জানার জন্য ফোন দিই তাকে। তখন বলেন, ‘আমি বাসায় চলে আসতেছি।’ কিন্তু তার আর জীবিত বাসায় ফেরা হয়নি। আসার পথেই পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের ছোড়া গুলি তার মাথায় এসে লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন জালাল। পরে কারফিউর মাঝেই শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে দাফন করা হয়।’