সতের বছরের মোহাম্মদ ইয়াসিন সংসারের খরচ যোগাতে এই বয়সেই করতেন রাজমিস্ত্রির কাজ। কাজের সুবাদে থাকতেন রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায়। ইয়াসিনের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানার ৫ নম্বর বড়পাতা ইউনিয়নে। বয়স্ক বাবা-মা আর পাঁচ ভাইবোন নিয়ে তাদের পরিবার। বড় ভাই সোহাগ ও শিপন মিয়াও থাকেন ঢাকাতেই। অন্য দুই ভাই ও একমাত্র বোন ভোলায় থাকেন বাবা-মায়ের সঙ্গে।
জুলাইয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর পরিবারের সবাই জানতেন আগের মতোই প্রতিদিন রাজমিস্ত্রির কাজে যান ইয়াসিন। বড় দুই ভাই সোহাগ ও শিপন মিয়ার সঙ্গে প্রতিদিনই তার কথা হতো মোবাইল ফোনে। ১৬ জুলাই যখন শহীদ হলেন আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরামসহ বাবা-মা অনেকেই সেদিন ইয়াসিনকে নিষেধ করলেন যেন আন্দোলনে না যান। বাধ্য সন্তানের মতো ইয়াসিনও বাবা-মাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি যাবেন না এসবের মধ্যে।
কিন্তু দেশপ্রেম কি আর পরিবার বোঝে? ১৭ তারিখ থেকেই সারাদিনের কাজের ফাঁকে পালিয়ে আন্দোলনে যেতে শুরু করেন ইয়াসিন। কিন্তু সে কথা জানত না পরিবারের কেউই। এমনকি ঢাকায় থাকা তার তার বড় দুই ভাইকেও জানাননি সে কথা। জুলাইয়ে আন্দোলন শুরুর পর সাইনবোর্ড এলাকা ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। সব শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল সাইনবোর্ড, কাজলা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায়।
১৯ জুলাই শুক্রবার ঢাকার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের পরেই কয়েকদিনে শহীদ হওয়াদের গায়েবানা জানাজা এবং দোয়ার আয়োজন করা হয়। মুসল্লিরা জুমার পর বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। সাদা পাঞ্জাবি, জায়নামাজ হাতে ঢল নামে হাজার হাজার মুসল্লির। রাজপথ ছেয়ে যায় মানুষের পদচারণায়। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডাররা নিরীহ নিরস্ত্র মুসল্লিদের উপর গুলি চালায় নির্বিচারে। আজিমপুর, মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ডে ঝরে অনেক বিক্ষোভকারীর রক্ত। শহীদ হন অনেকেই।
মোহাম্মদ ইয়াসিন সেদিন আন্দোলনে নামেন সাইনবোর্ডে, এসবি গার্মেন্টসের সামনে। পরিবারের কাছে ইয়াসিনের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো বর্ণনা বা তেমন কোনো তথ্য নেই। পরিবারের অজান্তে জীবন উৎসর্গ করা ইয়াসিনের গল্প সত্যিকার অর্থেই হৃদয়বিদারক।
ইয়াসিন শহীদ হন এসবি গার্মেন্টসের সামনে। আন্দোলন দমনে বাদ জুমা অন্য সব এলাকার মতো সাইনবোর্ডেও গুলি চালায় পুলিশ। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, লাশের স্তূপ জমে যায় সাইনবোর্ডে। কেউ কাউকে চিনতে পারছিলেন না। এতে করে একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায়, ইয়াসিনের মতো অনেক শহীদ কর্মস্থল ছেড়ে আন্দোলনে নেমে এসেছিলেন দেশের টানে। শহীদ হওয়ার পর তাদের স্থানীয় লোকজন চিনতে পারেননি। কারণ তাদের বাড়ি দেশের বিভিন্ন এলাকায়, কেউই ওখানকার স্থানীয় না।
১৯ জুলাই শুক্রবার ইয়াসিনের ফোন থেকে কোনো কল আসে না ভাইদের ফোনে। তবে এ নিয়ে তাদের টেনশন ছিল না। কারণ মা-বাবা, ভাই, বোন সবাইই জানে রাজমিস্ত্রির কাজে ব্যস্ত ইয়াসিন। পরদিন শনিবার সকাল ছয়টা বাজে বড় ভাইয়ের ফোনে একটা কল আসে অপরিচিত নম্বর থেকে। ফোন দিয়ে পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। বলা হয়, এই নম্বরটা ওয়াল পেপারে সেভ করে রাখা একটা ছেলে, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।
যে কোনো সময় শহীদ হতে পারেন এটা জেনেই হয়তো ওয়াল পেপারে ভাইদের সব তথ্য টুকে রেখেছিলেন ইয়াসিন। নিজের স্বপ্ন, পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভুলে জীবন উৎসর্গ করলেন দেশের জন্য। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে বড় দুই ভাই ছুটে গেলেন সাইনবোর্ড এলাকায়। গিয়ে দেখেন নিথর পড়ে আছে ভাইয়ের লাশ, পাশে তার মোবাইল ফোন। স্ক্রিনে লেখা আছে তারই তথ্য। বড় ভাইদের চোখের সামনে ছোট ভাইয়ের নিথর দেহ। পৃথিবীতে এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না।
সাইনবোর্ড থেকে ভাইয়ের লাশ নিয়ে তারা রওনা হন ভোলার উদ্দেশ্যে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে তারা জানান, ইয়াসিন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইয়াসিনের ভাই বলেন, লাশ নিয়ে চেক পোস্টগুলোতে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন কয়েকবার। নিতান্তই গরিব আর অসহায় বলে ছাড়া পেয়েছেন পুলিশের হাত থেকে। সন্ধ্যার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নিয়ে ভোলায় পৌঁছান তারা। বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স দেখে বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে বাবা-মায়ের, ভাই বোনের। অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের করা হয় ইয়াসিনের লাশ। ইয়াসিনের ভাইয়ের ভাষায়, ‘আব্বা-আম্মা পাথর অইয়া গেছেন ইয়াসিনের লাশ দেইখ্যা। আমাগো কোনো জবাব আছিলো না। কী কমু কন?’
দেশের পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ। আন্দোলনে শহীদ হওয়া লাশ দাফন করা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সেজন্য দেরি না করে অল্প কিছু মানুষ নিয়েই জানাজা সম্পন্ন করে রাতেই দাফন করা হয় ইয়াসিনের লাশ। কারো কাছে মুখ খোলারও সাহস পায়নি পরিবারের কেউ।
শহীদ ইয়াসিনের জীবনের আরো একটা গল্প আছে। যে গল্প শুরু হয়েছিল শহীদ হওয়ার কেবল একদিন আগেই। সেটা ছিল ইয়াসিনের বিদেশ যাওয়ার গল্প। বিদেশে গিয়ে উপার্জন করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। ইয়াসিন শহীদ হওয়ার পর তার সেই স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন তার ভাই মোহাম্মদ সোহাগ।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ফোনের ওয়ালপেপারে আমার নম্বর লিখে আন্দোলনে গেল। তার মানে ও জানত মারা যাবে। অথচ তার একদিন আগে ১৮ জুলাই ইয়াসিন পাসপোর্ট করার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছিল। এখন আপনারা আমারে বলেন, আমি কেমনে মাইনা নিমু আমার ভাইটা আর জ্যাতা (জীবিত) নাই?’
ইয়াসিনের ইচ্ছা ছিল ওমানে যাওয়ার। তিনি শুনেছিলেন, ওমানে রাজমিস্ত্রির জন্য ভালো কাজ আছে। তাই ওমান গিয়ে টাকা কামাই করে বাবা-মাকে সুখে রাখতে চেয়েছিলেন। ছোট বোন আর ভাইটাকে পড়াশোনা করাবেন। তার সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল। অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে কবরে শায়িত আছেন শহীদ ইয়াসিন। বিভিন্ন জনের দালানকোটা তৈরির কারিগর ইয়াসিন নিজের জীবন দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পিলার হয়ে শুয়ে আছেন কবরে। তার মতো হাজারো শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।