প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫, ০৯: ৪৪
সেকেলে আইনের ওপর ভর করে বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। সম্প্রতি জুলাই গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসাধারণের অসন্তোষ প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক বিক্ষোভ আয়োজনে বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই ধরনের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ ক্ষেত্রেও, প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলপ্রয়োগের মুখোমুখি হয়েছে, এমনকি পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলেও।
এ ধরনের ঘটনার মূলে রয়েছে— পুলিশকে জননিরাপত্তা নিশ্চিত এবং জনগণের মানবাধিকার রক্ষার প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা অনেক আগেই স্থবির হয়ে গেছে, যেটি ঔপনিবেশিক যুগের একটি আইন যা এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে অনুমোদন করে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রণীত একটি প্রগতিশীল পুলিশ অধ্যাদেশ পরের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছুড়ে ফেলে।
অপর একটি সেকেলে আইন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের কার্যপ্রণালির পদ্ধতিগুলো মূলত ১৯৪৩ সালের বাংলার পুলিশ রেগুলেশনে নির্ধারিত, যা আরেকটি পুরোনো ঔপনিবেশিক যুগের আইন। আন্তর্জাতিক আইনের বিপরীতে, এই বিধিমালা পুলিশকে সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনে বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। এমনকি প্রয়োজনে পুলিশকে সরাসরি জনতার ওপর গুলি করার অনুমোদনও দেয়।
সাবেক কর্মকর্তাদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওএইচসিএইচআরকে জানিয়েছেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্পত্তি রক্ষায় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অনুমোদন রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নিষিদ্ধ। এ ধরনের বলপ্রয়োগ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালা এবং মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের পুলিশ আইন হালনাগাদ করা জরুরি।
নিরাপত্তা বাহিনীতে রাজনীতিকরণের প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক দলের ১৫ বছরের শাসনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকরণ ঘটে, বাদ যায়নি নিরাপত্তা বাহিনীও। অনেক পুলিশ অফিসারকে পেশাদারিত্ব, সততা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নয় বরং আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থিত ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আনুগত্য বা সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে, ডিজিএফআই, এনএসআই ও স্পেশাল ব্রাঞ্চ মধ্যম ও উচ্চ পদের জন্য প্রত্যেক প্রার্থীকে যাচাই-বাছাই করেছিল প্রার্থী, এবং তাদের আত্মীয়দের রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে ডেপুটি ইন্সপেক্টর-জেনারেল বা উচ্চ পদে যে কোনো নিয়োগের বিষয়ে অনুমোদন করতেন। আওয়ামী লীগের অনুগতদের কৌশলগতভাবে মহানগর পুলিশ বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বসানো হয়েছিল।
প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। যদিও সেনাবাহিনীকে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর তুলনায় কম রাজনীতিকীকরণ করা হয়, তবুও কর্মরত সেনা কর্মকর্তা এবং অভ্যন্তরীণ তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কয়েকজন ওএইচসিএইচআরকে বলেছেন, সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দলীয় রাজনীতি দ্বারা পরিবেষ্টিত, বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে। রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঢাকা এবং সেনা সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে অথবা নিয়োগ করা হয়েছে।
অন্যদিকে অবিশ্বস্ত হিসেবে বিবেচিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, দূরবর্তী পদে নিয়োগ করা হয়েছে অথবা কিছু ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়তে অবৈধভাবে চাপ দেওয়া হয়েছে। ফলে কেবল সেনাবাহিনীই নয়, বরং আধাসামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল আরো বেশি অপব্যবহারের সুযোগ পায়; যাদের নেতৃত্বে ছিলেন সেনা কর্মকর্তারা এবং যারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করতেন।