সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৫৪ অপরাহ্ন

বিচারকের স্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি শিশুও

রিপোটারের নাম / ৮৯ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৫৮
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৫৯

চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী নুর আলম জুয়েল। স্ত্রী ফারজানা পাটোয়ারী ও দুই ছেলে নিয়ে সাজানো-গোছানো সংসার তার। নিজের জমানো টাকা ও অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে চট্টগ্রামের সদরঘাটে কেনেন একটি ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাট এখন হয়ে উঠেছে এই পরিবারের গলার কাঁটা।

পরিবারটির অভিযোগ, ফ্ল্যাট দখলে নিতে চাঁদাবাজি-হত্যাচেষ্টার মামলা ও জিডি দিয়ে গত এক বছর হয়রানি করছেন জায়গার মালিকের মেয়ে আইনজীবী তানজিলা মান্নান যুথী এবং তার স্বামী। তানজিলা চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী ও অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত। তার স্বামী সাইফুল আলম চৌধুরী জুডিশিয়াল সার্ভিসের কর্মকর্তা। সাইফুল বর্তমানে অতিরিক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিলেটের হবিগঞ্জে কর্মরত।

জুয়েলের অভিযোগ, স্বামী বিচারক এবং তানজিলা নিজে আইনজীবী হওয়ার কারণে প্রভাব খাটিয়ে সদরঘাট থানায় আমাদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, শ্লীলতাহানিসহ চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া একের পর জিডি ও মামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে। ফ্ল্যাট দখল নিতে চলাচলের পথ সীমিত করে পাকা দেয়াল তোলা হয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) তদন্ত করে বলেছে, তানজিলা ইমারত আইন লঙ্ঘন করেছে। আমার ১১ বছরের ছেলে তাফহিম আহনাফ তানিমকেও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে।

পরিবারটি এসব ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, আইনমন্ত্রী, আইন সচিব, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, আইজিপি, বার কাউন্সিলরের চেয়ারম্যান, সিএমপি কমিশনার, সিডিএ বরাবর তানজিলা ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়। তবে অদৃশ্য কারণে এই বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। বরং উল্টো তাদের দিন কাটছে তানজিলার হুমকি-ধমকিতে।

এদিকে পুলিশ চাঁদাবাজি মামলার পর তদন্ত করে এরই মধ্যে ঘটনার সত্যতা না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। পরে আইনজীবী তানজিলা নারাজি দিলে আদালত সেটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের জন্য দেয়। পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট তদন্ত করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গত মাসে। দুটি সংস্থাই মামলার কোনো সত্যতা পায়নি। ফলে নুরে আলমের স্ত্রী, ছেলে এবং শ্বশুরকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলেছেন তারা। অন্যদিকে অধিকতর তদন্তে পিবিআই শুধু জুয়েলের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২৩ ধারায় প্রসিকিউশন দাখিল করেছে।

মামলার নথিতে দেখা যায়, ঘটনা শুরু ২০২৩ সালের ১১ জুলাই। সদরঘাট থানা এলাকার মাদারবাড়ীর স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী তানজিলার বাবা আব্দুল মান্নান ও তার দুই চাচা এই জায়গার মালিক। তানজিলার চাচার কাছ থেকে ২০১৬ সালে রেজিস্ট্রিমূলে ভবনের চারতলায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন ব্যবসায়ী জুয়েল। ভবনটির নিচতলায় পার্কিং ও মুরগির দোকান। তৃতীয়তলায় আব্দুল মান্নানের ফ্ল্যাট রয়েছে। জুয়েল নিজ খরচে তার ফ্লাট বি-৩-এর ডেকোরেশনসহ অন্যান্য কাজ সমাপ্ত করে সেখানে বসবাস করছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তানজিলা বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় বসবাস করলেও বাবা-মার ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করেন।

এজাহার অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১১ জুলাই রাত ১০টার দিকে জুয়েল তার ফ্ল্যাটের পাশে খালি জায়গায় সাইফুল আলমসহ কয়েকজন লোক দেখতে পেয়ে তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হলে সেখানে হাজির হন আইনজীবী তানজিলা। একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশে খবর দেন তানজিলা। সদরঘাট পুলিশের টহল টিম এসে জুয়েলসহ তার স্ত্রী ও শ্বশুর ইদ্রিস আলীকে থানায় নিয়ে যায়। তখন থানায় যান তানজিলা ও তার স্বামী সাইফুলও।

জুয়েল বলেন, আমি তানজিলার স্বামীকে চিনতাম না। সেদিন অপরিচিত লোকদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তানজিলা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে আমাদের। একপর্যায়ে আমার দিকে তেড়ে এলে আমার স্ত্রী ও শ্বশুর আমাকে বাঁচাতে তাকে নিবৃত্ত করে। কিন্তু তারা পুলিশ দিয়ে আমাদের থানায় নিয়ে যায়।

নথিতে তানজিলা অভিযোগ করেন, ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে বাধা দিয়ে আসামিরা তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন। জুয়েলের শ্বশুর পেছন দিক থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে শ্লীলতাহানি করেছেন। জুয়েল তার স্ত্রী সন্তানসহ তাকে মারধর করে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিয়ে আহত করেছেন। হত্যার উদ্দেশ্যে ভবনের খালি অংশে নিয়ে গেলে তার স্বামী সাইফুল ইসলাম দৌড়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার পরপরই মামলাটি লিপিবদ্ধ করেন সদরঘাট থানার তৎকালীন ওসি গোলাম রব্বানী।

পরে ওই মামলার তদন্তভার পান সদরঘাট থানার উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) আকতার হোসেন। এই মামলা চলাকালে আইনজীবী তানজিলা সদরঘাট থানায় আরেকটি জিডি করেন। আসামিরা জামিনে বেরিয়ে দা ছুরি, লাঠি নিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়েছে এবং আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কিনে নিয়েছেন বলে জিডিতে অভিযোগ করা হয়। পরে আদালত জিডিটি আগের মামলার সঙ্গে নথিভুক্ত করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের কাছে তদন্তের জন্য পাঠায়।

এই জিডির বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে ডিবির এসআই ফজলে রাব্বি কায়সার। তিনি সেখানে অভিযোগকারীর উল্লেখিত বিষয়ে কোনো কিছুই পাননি বলে জানান।

সদরঘাট থানার এসআই আকতার ১৭ জুলাই আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে বাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করে জখম ও শ্লীলতাহানির স্বপক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি মামলার বাদী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। তদন্তকালে বাদীর স্বামী ও রাজমিস্ত্রিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টা করলেও তাদের পাওয়া যায়নি। বাদী আহত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হলেও তার স্বপক্ষে কোনো কাগজ উপস্থাপন করতে পারেননি।

মামলা গ্রহণের বিষয়ে তৎকালীন সদরঘাট থানার ওসি ও বর্তমানে নগরীর আকবরশাহ থানার ওসি গোলাম রব্বানী বলেন, আইনজীবী তানজিলা এবং তার স্বামী (সাইফুল) থানায় সে দিন উপস্থিত ছিলেন। আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে তাদের করা মামলা নিলেও তদন্তে যা পেয়েছি তাই দিয়েছি। এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’ তবে কীভাবে একজন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রকে কোনো কিছু যাচাই ছাড়াই চাঁদাবাজি ও হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি করা হলো জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

ঘটনার বিষয় জানতে চাইলে সিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মামলা হলেও আমরা সঠিকভাবে তদন্ত করে তার ফলাফল আদালতকে জানিয়েছি। তদন্তের সময় পুলিশ অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি। মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মামলা তদন্তে করতে গিয়ে যা পেয়েছি তাই আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। মামলার বিষয়ে জানতে গত বৃহস্পতিবার তানজিলাকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, আপনি আসামিদের পক্ষ নিয়ে আমাকে ফোন করেছেন। মামলাটি বিচারাধীন তাই বিষয় নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ