বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। তারা দৃশ্যপটে থাকলেও পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল একদল ষড়যন্ত্রকারী। তারাও একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ওই ঘটনায় কয়েকজনের বিচার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে নেপথ্য কুশীলবরা।
২০১২ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে যত শিক্ষার্থী আবরারের মতো নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও দায়ী করেছেন ভুক্তভোগীরা । তাদের অভিযোগ, বুয়েট প্রশাসন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সব বর্বরতা সম্পর্কে জানলেও এসব বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; বরং সহায়তাসহ উসকে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করেছে আমার দেশ।
শিক্ষার্থী নির্যাতনে ছাত্রলীগকে সহায়তার বিষয়ে তৎকালীন তিন উপাচার্য, তিন ছাত্রকল্যাণ পরিচালকসহ বিভিন্ন আবাসিক হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে এ প্রতিবেদকের কাছে গুরুতর অভিযোগ করেছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী ছাত্র ও শিক্ষক। তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, প্রশাসনের প্রশ্রয়েই বুয়েটে দিনে দিনে দানবীয় রূপ ধারণ করে ছাত্রলীগ।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আবরার হত্যার নেপথ্য কুশীলব ছিল ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেল ও বেশকিছু সদস্য। তারা শাহবাগপন্থি ও কট্টর ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত।
আবরার হত্যার আগে কয়েক বছর ধরে আড়িপাতা গ্রুপটির কয়েকজন অ্যাডমিন ও সদস্যের বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট, গ্রুপে তাদের বিভিন্ন মন্তব্য উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে আছে কীভাবে তারা আবরারের মতো মেধাবী শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করেছে। কেবল আবরার নয়, তারও কয়েক বছর আগে থেকে বুয়েটে ধার্মিক শিক্ষার্থীদের শিবিরকর্মী আখ্যা দিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের যে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছিল ছাত্রলীগ, সেসব ঘটনারও পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল আড়িপাতা গ্রুপটির চিহ্নিত সদস্যরা।
যেভাবে রচিত হয় আবরার হত্যার পটভূমি
‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ গ্রুপের আবির্ভাব ২০১২ সালে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতেন। খুব কম সময়ে ওই মহলে গ্রুপটি ব্যাপক পরিচিতিও লাভ করে।
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় শাহবাগপন্থি আর ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে রূপ নেয় ‘বুয়েটের আড়িপেতে শোনা’ গ্রুপ। এক পর্যায়ে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে শিবিরমুক্ত করার মিশনে নামে। এরই অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ইসলামপন্থি হিসেবে পরিচিত, যারা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও ভারতের কোনো ধরনের সমালোচনা করেছে, তাদের ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে পরের বছরের ৮ জানুয়ারি তালিকা প্রকাশ করে আড়িপেতে শোনা গ্রুপ। তালিকা ধরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শিবির আখ্যা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। সে তালিকায় কথিত শিবির হিসেবে ৪৪ জনের নাম ছিল। সেটি তৈরি এবং প্রকাশে অন্যতম ভূমিকা রাখেন গ্রুপের তৎকালীন অ্যাডমিন বুয়েটের ১৯৮৯ ব্যাচের এলামনাই ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাইট হরাইজন সফটওয়্যার কোম্পানিতে কর্মরত জাভেদ ইকবাল।
নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের অনেকে আমার দেশকে জানিয়েছেন, তালিকাটি তৈরি ও প্রকাশের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন অ্যাডমিন মিশকাত আল আলভি (ইইই-০৭), এমডি মাসুদ করিম খান (সিএসই-৮৯), চন্দ্রনাথ (এমই-৯৭), শরিফুল ইসলাম শান্ত (ইইই-০৩), সৈকত বিশ্বাস (সিই/ডব্লিউআরই-০৪), তন্ময় বাড়ৈ (এমই-০৯) প্রমুখ। তাদের শিবিরবিরোধী প্রচারের নির্মম শিকার হন ধার্মিক ও ভারতবিরোধী শিক্ষার্থীরা, যাদের সঙ্গে শিবিরের দূরতম সম্পৃক্ততার প্রমাণ ছিল না। আবরার হত্যা এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
আড়িপাতা গ্রুপের শাহবাগপন্থি, ইসলামবিদ্বেষী সদস্য ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে ঘৃণ্য প্রচারের কারণে বুয়েটে তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, বুয়েটে শিবির করা অপরাধ; কিন্তু তাকে নির্যাতন করায় কোনো দোষ নেই। শিবির মানে সমাজ-দেশের শত্রু। তাদের বুয়েটে অধ্যয়ন এবং এ দেশে থাকারও অধিকার নেই। এ ছাড়া ধার্মিক ও ভারতবিরোধী শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের পক্ষে নানা যুক্তিও উপস্থাপন করা হতো গ্রুপে।
বয়ান তৈরির কারিগরদের অন্যতম ছিলেন অভিষেক মুহুরী (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-১৪)। তিনি ‘শিবির করলেই তাকে মারধর কেন করতে হবে’ শিরোনামে বিশাল এক মন্তব্য করে অন্যদের উসকে দেন; ফারাবি ইবনে জামাল (ইইই-০০) এক কমেন্টে লিখেছেন, ‘শিবির খোঁজা শুরু হোক’। অনিক আন্দালিব (ইইই-০২) শিবিরের বিষয়ে লিখেছেন, ‘এদের প্রতি বিন্দুপরিমাণ সহানুভূতি, ‘কিন্তু’, ‘তবে’, ‘যদি’ থাকা উচিত নয়।
দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘সংযোগের’ প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাবেদ জামাল (কেমিক্যাল-৯৮) লেখেন, ‘শিবির বের করতে ভোটাভুটি লাগে? বরং হাইকোর্টে আপিল হোক, শিবিরিয়ানদের সার্টিফিকেট বাতিল হোক।’ এ ব্যাপারে আহমেদ জাবেদ জামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনি সঠিক তথ্য আগে জানেন। এসব কথা আপনাকে কে বলেছে? এরপর তার কমেন্ট তাকে পড়ে শোনানো হলে তিনি বলেন, ‘আপনি যা পারেন, তা-ই লেখেন।’
অমিতাভ মঙ্গল নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘মা কালীর ডাকে যদি পেটানো জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোপানো জায়েজ হওয়াটাও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।’ শরিফুল ইসলাম শান্ত (ইইই-০৩) লিখেছেন, ‘যে অভিজিত রায় হত্যার পর কুৎসিত উল্লাস করে, সে-ই তো জামাতি, যে অন্য ধর্মের মানুষকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে, সেই তো জামাতি, যে পদে পদে মিথ্যা কথা বলে নিজের সুবিধার জন্য, সেই তো জামাতি, যে প্রশ্ন করলে বলে ইয়ে মানে ‘যুদ্ধাপরাধ বিচার হতে হবে কিন্তু …, সেই তো জামাতি।’
আড়িপেতে শোনা গ্রুপে প্রকাশিত শিবির নেতাকর্মীর তালিকা ও তাদের এ ধরনের প্রচারণাকে ভিত্তি করে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসকে শিবিরমুক্ত করার নৃশংস অভিযানে নামে। এর অংশ হিসেবে ধার্মিক শিক্ষার্থীদের ওপরও নির্যাতন শুরু হয়। সেখান থেকেই যাত্রা করে দেশের গৌরব এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কলঙ্কজনক এক দীর্ঘ অধ্যায়। প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে ও বিভিন্ন আবাসিক হলের টর্চার সেলে একের পর এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়, হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয় পঙ্গু করে। আবার অনেককে আধমরা অবস্থায় জঙ্গি তকমা দিয়ে তুলে দেওয়া হতো পুলিশের হাতে । নির্যাতন করে তারাই মিথ্যা মামলা দিত ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থী আববারকে শিবির আখ্যা দিয়ে সারা রাত পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা।
বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার অনেক শিক্ষার্থী বলেছেন, আবরার নিহত হয়েছেন, তাই তাকে নিয়ে তোলপাড় হয় সারা দেশ। কিন্তু একই কায়দায় বুয়েটের আরো অনেক শিক্ষার্থীকে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন করেছে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। তারা প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় প্রকাশই হয়নি ছাত্রলীগের পৈশাচিক বর্বরতার করুণ কাহিনি।
জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাসহ অন্যদের ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে শাহবাগে । বুয়েটের তখনকার অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের বক্তব্য অনুসারে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের ধারাবাহিকতায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সক্রিয় হয় ফ্যাসিবাদকে সমর্থনকারী এই গ্রুপটি।
নানা মাধ্যমে তারা তাদের ফ্যাসিবাদী চেতনা প্রকাশের পাশাপাশি সংঘবদ্ধ হতে থাকে। তারা অস্থির করে তোলে ক্যাম্পাস। বুয়েটের ফ্যাসিস্টপন্থি এই গ্রুপ তাদের হীনলক্ষ্য চরিতার্থ করতে থাকে। বৈধতা দিতে থাকে বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনের পৈশাচিক সব ঘটনাকে। ক্যাম্পাসে দিনদুপুরে আড়িপাতা গ্রুপের এই শিবির তালিকার কেউ ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হলে এবং এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে কেউ কোনো পোস্ট দিলে শাহবাগপন্থি সদস্যরা গ্রুপে নানা মন্তব্যের মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার বিরুদ্ধে। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করত যে, নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী জামায়াত-শিবির । এ কারণে ছাত্রলীগ আরো উৎসাহের সঙ্গে চালিয়ে যেতে থাকে নির্যাতন-নিপীড়ন। শিবির তকমা দিয়ে ধার্মিক শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের জন্য ছাত্রলীগ বিভিন্ন আবাসিক হলে গড়ে তোলে টর্চার সেল। টার্গেট করা শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রড, পাইপ, স্টাম্প, হাতুড়ি ও কাচের বোতল দিয়ে পেটানো হতো। দিত জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা। নির্মম নির্যাতনের শিকার কয়েক শিক্ষার্থী আমার দেশকে বলেছেন, তাদের শরীরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা একের পর এক স্টাম্প ভেঙেছে । এক পর্যায়ে জ্ঞান হারাতেন তারা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বুয়েট এলামনাই তোফাজ্জল হোসাইন (সিই-০৯) তার সময়ের পরিবেশ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বুয়েটে একটা গ্রুপ ছিল ‘আড়িপাতা’Ñ যেটা ছিল অনলাইন টর্চার সেল। তবে ক্যাম্পাসে, অনলাইনে কিংবা অফলাইনে, বিরোধী মতের কাউকে পেলেই মারধর করত। তাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল শিবির। হল থেকে শিবির তাড়ানোর পর, ছাত্রফ্রন্ট তাড়াল। এরপর নিয়মিত নামাজ পড়লে তাদের ওপর অত্যাচার চলত। ছাত্রলীগের সেই মূল গ্রুপটি মদ খেয়ে কাউকে মারার মতো পেলে বুধবারে পার্টি করত।’
রক্ষা পাননি শিক্ষকও
বুয়েটে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ঘটে আরেক ন্যক্কারজনক ঘটনা। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে আড়িপাতা গ্রুপে একটি কমেন্ট করেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। এ কারণে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাকে তার কক্ষ থেকে শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে শত শত শিক্ষার্থীর সামনে মারধর করে। অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের ওপর হামলার পেছনেও উসকানি ছিল আড়িপাতা গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেলের। যেমন সাবেক এক অ্যাডমিন এক পোস্টে লিখেছেন, ‘বুয়েট শিক্ষক বলে এই জামায়াতকর্মীকে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।’
ক্যাম্পাসে হামলার পর আড়িপাতা গ্রুপ থেকে নিষিদ্ধ করা হয় অধ্যাপক জাহাঙ্গীরকে। তাকে নিষিদ্ধ করে গ্রুপের অ্যাডমিন মিশকাত আল আলভি লেখেন, ‘কেপি (কাঁঠালপাতা) টেস্টে সাফল্যের সঙ্গে পাস করার জন্য বুয়েটের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রুপ থেকে ‘ব্যান’ করা হল। #‘ছাগুসব- করে -রব- ফাঁসি- হইল…’।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রনাথ (মেকানিক্যাল-৯৭) এক পোস্টে লেখেন, ‘সরাসরি সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী কথা বলার অপরাধে এই শিক্ষকের অপসারণ শুধু নয়, আইনের আওতায় আরো বড় পরিসরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। … উনাকে ভিন্ন মতাবলম্বী বলে দায়িত্ব এড়ালে চলবে না।’
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আড়িপাতা গ্রুপের এ ধরনের ঘৃণার চাষ এবং উসকানি দিয়ে একের পর এক পোস্ট দেওয়ার পরদিনই ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে তার ওপর হামলা চালায়। কেবল হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে বহিষ্কারেরও দাবি তোলে শাহবাগপন্থিরা। বুয়েট প্রশাসন ছাত্রলীগ ও ফ্যাসিবাদীদের পক্ষ নিয়ে পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করে অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের ওপর। বাতিল করা হয় বুয়েটে তার সব একাডেমিক কার্যক্রম।
তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে তার ওপর অত্যাচারের বিস্তারিত ঘটনা তুলে ধরেন। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং বুয়েট থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন তারই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার খানকে, যিনি তখন ছিলেন বুয়েটের উপ-উপাচার্য । অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আমার দেশকে বলেন, ‘চাকরি ও বুয়েটের বাসা ছাড়ার জন্য বিভিন্ন লোক মারফত চাপ দিতে থাকেন আবদুল জব্বার। অন্যথায় আরো মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হতো। অবশেষে নিরাপত্তার কারণে ২০২০ সালে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য অধ্যাপক আবদুল জব্বার খানের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’ তবে ফোন ধরেননি চন্দ্রনাথ। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠালে তিনি ফোন করার কারণ জানতে চান। কারণ লিখে জানালে তিনি অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ চেয়ে পাল্টা মেসেজ পাঠান। এরপর অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তার করা একটি পোস্টের ছবি তুলে পাঠিয়ে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আহমেদ মুছাফ্ফা নামে বুয়েটের সাবেক এক শিক্ষার্থী অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক পেটানোর ঘটনা বুয়েটের ইতিহাসে এই প্রথম। এ ঘটনার ইন্ধনদাতা হলো আড়িপাতা গ্রুপ।’
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তখন একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আড়িপাতার সাবেক অ্যাডমিন রাগিব হাসান। সম্প্রতি তিনি তার এক পোস্ট এবং অতীত জীবনের ভুলের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে দীর্ঘ এক পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে। এতে তিনি অধ্যাপক জাহাঙ্গীরসহ সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। রাগিব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিভাগের অধ্যাপক। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তাকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ভুল ছিল ওই পোস্ট। সেজন্য আমি আল্লাহর কাছে এবং অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং তার সঙ্গে আমার বর্তমানে খুব ভালো সম্পর্ক।’
আড়িপাতা গ্রুপের সাবেক অ্যাডমিন নাসরুল ইসলাম সোহানও (কেমিক্যাল-০২) ২০২০ সালে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণের জন্য ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন।
আড়িপাতা গ্রুপের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ
বুয়েট শিক্ষার্থী নুরে আলম সিদ্দিকি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আবরার হত্যার পটভূমি তৈরির জন্য আড়িপাতা এবং এর এলিট অনেকে দায়ী।’
এনামুল হক রাইয়ান নামে বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘এরাই আবরার হত্যাকারীদের উত্তরসূরি। এদেরও বিচার হওয়া উচিত। জামায়াত-শিবির ট্যাগিং দিয়ে গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া শুরু করেছেন উনারা, আর দুনিয়া থেকে বের করে দেওয়ার কাজটা করেছে এদের অনুসারীরা।’
সাফফাত হোসেন নামে আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘শিবির তকমা ব্যাপারটা জাভেদ ইকবাল এবং তার অনুসারীরা যেভাবে উৎসবের আমেজে উদযাপন করেছে, তাতে ছাত্রলীগের অনুসারীরা যা ইচ্ছা তা করার লাইসেন্স পেয়েছে। এর পরিণতি ছিল ৫ বছরের মাথায় আবরারের মৃত্যু।’
জুয়েল ফাহাদ নামে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘আবরার হত্যার পরিবেশ তৈরিতে এরকম শত শত জাভেদের রক্তাক্ত হাত আছে।’
আল আমিন খান চৌধুরী নামে আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘এই গ্রুপ ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সরকারবিরোধীদের হেনস্তার জন্য ঘৃণার চাষ করেছে। যার কারণে অপদস্থ হয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে একজন মেধাবী ছাত্রকে ।’
আড়িপাতা গ্রুপের অন্য ফ্যাসিবাদী সদস্যদের নাম
বুয়েটে আবরার হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরিতে মিশকাত, তন্ময়, চন্দ্রনাথ, জাবেদ, সৈকত বিশ্বাসদের সঙ্গে আরো যারা ভূমিকা রাখেন তারা হলেনÑ চন্দন শিকদার (ইইই’০০), রিসালাত বারি (ইইই’০১), ইয়াসির আরাফাত (ইইই’৯৮), বিধান চৌধুরী (কেমিক্যাল’৯৬), জয়দীপ দাস (সিএসই), ফারহান ইবনে জামাল (ইইই’০০), শরিফ চয়ন (সিভিল’০৪), অর্নব মালাকার (এমএমই’১০), গোলাম মোস্তফা, হামিদুল হাসান নবিন (ইউআরপি’০৭), ফাইয়াজ জামাল (সিএসই’৯৯), মাহফুজুর রশিদ সাচ্চু (সিভিল’৯৫), আবদুস সালেক রেজা (সিভিল’৯৬), আলবাব ইয়াফেজ ফাতমি (সিভিল’০৪), সুতপা দাস (আর্কিটেকচার), ফারহানা জিসা (আইপিই’০৫), নসরুল ইসলাম সোহান (কেমিক্যাল’০২), শরিফুর রহমান সৌরভ, আহমেদ জাবেদ জামাল (কেমিক্যাল-৯৮), খালেদ রেদওয়ান চৌধুরী (ইইই-০৩), মোহাম্মদ উল্লাহ খান (ইইই-৯৪), ফাহমিদা শাহরীন টিউলিপ (ইইই-০২), আন্দালীব নিজাম (ইইই-০২), সালওয়া মোস্তাফা (ইইই-০১), আবু মুসা আবদুল্লাহ সৌরভ (মেকানিক্যাল’১১) ও চরম উদাস।
আবরার হত্যা ও ছাত্রলীগকে প্রশাসনের সহযোগিতা
বুয়েটে ২০১২ থেকে ১৯ সালে আবরার হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ধার্মিক শিক্ষার্থীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতনে ছাত্রলীগকে কীভাবে প্রশাসন সহায়তা করেছে তার অন্যতম সাক্ষী এমএমই বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান। তিনি আমার দেশকে বলেন, ২০১৮ সালের ঘটনা; তখন আমি বিভাগের প্রধান। আল আরাফাত হোসেন নামে আমার এক ছাত্র একদিন আমাকে ফোন দিল। সে বলল, ছাত্রলীগ তাকে খুঁজছে। আমি যেন তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করি। আমি ছিলাম আরাফাতের উপদেষ্টা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘তুমি কোথায়’। সে আমাকে জানাল ইসিই ভবনের ১৪ তলার একটি কক্ষে লুকিয়ে আছে। আমি ফোন দেই ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারকে। সত্য প্রসাদ সেখানে গেলেন এবং আমাকে জানালেনÑ ছাত্রলীগের ছেলেদের তিনি বুঝিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। কোনো সমস্যা নেই। আমি যেন আরাফাতকে নিয়ে যাই।
আমি আরাফাতকে আনার জন্য আমার বিভাগের শিক্ষক হুমায়ুন আহমেদকে পাঠাই। কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে আমাকে ফোনে জানালেন ছাত্রলীগের লোকজন তার কাছ থেকে আরাফাতকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি বললাম, তুমি মার খেলেও আরাফাতকে তাদের হাতে দেবে না। অনেক ঘটনার পর একটি রিকশায় করে তিনি আরাফাতকে আনলেন। রিকশায় তাদের পেছনে পেছনে মোটরসাইকেলে করে আসল ছাত্রলীগের ১২-১৩ জন। ততক্ষণে আমার বিভাগের আরো কয়েকজন শিক্ষক সেখানে হাজির হলেন। ছাত্রলীগের ছেলেরা আরাফাতকে শিবির আখ্যা দিয়ে তাদের কাছে তুলে দেওয়ার দাবি জানাল। আমি তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে তারা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বলল, ‘আপনারা রাজাকার ছেলেদের পড়ান। আপনারা স্বাধীনতাবিরোধী।’ এরপর তারা এক পর্যায়ে আরাফাতকে আমাদের কাছ থেকে জোর করে চুল ধরে মারতে মারতে নিয়ে গেল। আরাফাত তখন হাউমাউ করে কাঁদছিল। ছাত্রলীগের ছেলেরা আরাফাতকে জিমনেসিয়ামের পেছনে নিয়ে নির্মমভাবে পেটাল। তাকে পেটানোর দৃশ্য দেখতে ছিল এরকম এক ছাত্র আমাকে সেখান থেকে ফোন করে জানাল নির্যাতনের কথা। আমি তখন আমার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমিনুল ইসলামকে নিয়ে ছুটে গেলাম উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের কাছে। আমি তাকে সব ঘটনা বলার পর তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।’
আমি তার এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হলাম, প্রতিবাদও করলাম। এক পর্যায়ে আমি বললাম, আপনি কিছু না করেন অন্তত রেজিস্ট্রারকে বলেন। তখন তিনি বাধ্য হয়ে তার পিএস কামরুলকে বললেন রেজিস্ট্রারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে এবং পদক্ষেপ নিতে। এ সময় আমার কাছে খবর আসতে থাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা আরাফাতকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে চলছে। আমি তখন অওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন শিক্ষক, ছাত্রলীগের যারা মারছে তাদের কয়েকজনের সরাসরি শিক্ষকদেরও ফোন দিলাম। কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দিল না। ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারকে জানালাম আরাফাতকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ক্যাম্পাসে পেটাচ্ছে, তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন। তিনি তখন আমাকে বললেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি।’ তার এ কথা শুনে আমি আবারো হতবাক হলাম। আমি তাকে বললামÑ আপনি না বলেছিলেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা চলে গেছে। আরাফাত নিরাপদ। কিন্তু তিনি আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না এবং আরাফাতকে উদ্ধারেরও কোনো ব্যবস্থা নিলেন না।
তিনি আরো বলেন, পরে আমি রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলাম। তার উদ্যোগে এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসলেন লালবাগ থানার ওসি, উপ-ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মোস্তফা এবং চিফ সিকিউরিটি অফিসার। তারা গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, সেদিন যদি আরাফাতকে উদ্ধার করা না যেত তাহলে হয়তো ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হতো। আরাফাত সেদিন মারা গেলে সেটা হতো একটি টার্নিং পয়েন্ট এবং আবরার হয়তো মারা যেত না। আবরার মারা যাওয়ায় সেটা টার্নিং পয়েন্টে রূপ নেয় এবং জাতি জানতে পারে বুয়েটের অন্ধকার অধ্যায়ের কথা।
ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার আল আরাফাত হোসেন গত ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন । মামলায় তিনি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আসামি করেছেন বুয়েটের তখনকার ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (প্রক্টর) ও পরে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারকে । আরাফাত ছিলেন ২০১৫ ব্যাচের এমএমই বিভাগের ছাত্র।
আমার দেশকে আরাফাত বলেন, ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে নির্মম নির্যাতন করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ঘটনার পূর্বাপর পরিস্থিতি বিচার করে আমি বুঝতে পারি, আমার ওপর নির্যাতনের ঘটনায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মুজমদার। আমাকে ইসিই ভবনে ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রথমে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সত্য প্রসাদ মজুমদারকে অনুরোধ করেছিলেন আমার বিভাগের হুমায়ুন স্যার। তিনি যেন আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যান। কিন্তু সত্য প্রসাদ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তড়িঘড়ি করে চলে যান। পরে আমি বুঝতে পারি, আমাকে খুঁজে বের করে ওদের হাতে দেওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি আমাকে ছাত্রলীগের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
আরাফাত বলেন, আমাকে জিমনেশিয়ামের পেছনে নিয়ে শাপের মতো পেটায়। আমার পিঠে একটার পর একটা স্ট্যাম্প ভাঙতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই।
বুয়েটের তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে তিনি প্রশ্ন শেষ করার আগেই বলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব, এই বলে ফোন রেখে দেন। পরে ফোন করা হলেও তিনি আর রিসিভ করননি।
সত্য প্রসাদকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার নম্বরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেসেজ দেওয়ার পর কয়েকবার ফোন দিলেও জবাব পাওয়া যায়নি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার আরেক শিক্ষার্থী তানজিলুর রহমানের বাবা আলমগীর সিকদার। তানজিল ২০১১ ব্যাচের এমএমই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগ বুয়েটে তাকে দুই দফা নির্মম নির্যাতন করে। তানজিলের মামলায় তার ছেলের ওপর নির্যাতনের জন্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে বুয়েটের তখনকার ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনকে।
বিদেশে অবস্থানরত তানজিল আমার দেশকে বলেন, ২০১৪ সালে তিনি বিভাগীয় ল্যাবে যান অ্যাসাইনমেন্টের কাজে। তখন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাকে ধাওয়া করলে তিনি ল্যাবের গার্ডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাঁচার জন্য চিৎকার করেন। তখন বিভাগের অনেক শিক্ষক সেখানে হাজির হন। এক পর্যায়ে হাজির হন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু দেলোয়ার তাকে উদ্ধার না করে ফিরে যান। পরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা রুমের দরজা ভেঙে তাকে বের করে নির্মমভাবে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়াসহ গুরুতর জখম করে।
২০১৬ সালের ২ মে বুয়েটের শেরে বাংলা হল থেকে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যায় ইউআরপি’১১ ব্যাচের সোলাইমান খানকে। কেবল ধার্মিক হওয়ার কারণে সুলাইমানকে শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে সোলাইমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, রাত ১১টা থেকে পরের দিন সকাল ৭টা পর্যন্ত তিনিসহ মোট ছয়জনকে থেমে থেমে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। সোলাইমান লিখেছেন, ‘পরের দিন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন আমাকে ফোন করে উপদেশ দিয়ে বলেন, জলে বাসা করে তো আর কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। তুমি বাবা তাদের সঙ্গে মানিয়ে চল।’
সৈয়দ জিয়াউদ্দিনকে (এমই-০৯) বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে শত শত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের সামনে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা শাপের মতো পিটিয়ে অজ্ঞান করে। সম্প্রতি তার স্ত্রী শারিন সফি অদ্রিতা এক পোস্টে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. দেলোয়ার প্রসঙ্গে লিখেছেন, তাকে তখন ঘটনা জানানো হলেও তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার করার কিছু নেই।’
বুয়েটে নির্যাতনের শিকার এনামুল হক বলেন, ড. দেলোয়ার ছাত্রকল্যাণ পরিচালক থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার কোনো শিক্ষার্থী তার কাছ থেকে সহায়তা পাননি। তাকে জানানো হলে তিনি তাদের উদ্ধার করতেন না। লোক দেখানোর জন্য ঘটনাস্থলে গেলেও কাউকে তিনি উদ্ধার করতেন না।
শিক্ষার্থী নির্যাতনে সহায়তার অভিযোগ বিষয়ে ড. দেলোয়ারকে ফোন করা হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘এসব আগডুম বাগডুম বলে লাভ হবে না। আপনি তদন্ত করেন, বুয়েটে যান।’
তখন তাকে বলা হয়, তদন্তের অংশ হিসেবেই আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি অভিযোগ বিষয়ে। তখন ড. দেলোয়ার বলেন, ‘আপনি কে তদন্ত করার। এরপর ফোন রেখে দেন তিনি।’
২০১২ থেকে ২০১৯ সালে আবরার হত্যা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বুয়েটের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক খালেদা একরাম, অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার এবং অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ছিলেন ড. দেলোয়ার, ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার এবং ড. মিজানুর রহমান রফিক।
ড. মিজানুর রহমান ও ড. দেলোয়ার শিক্ষক থাকা অবস্থায়ই আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন।
ভুক্তভোগী কয়েক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নির্যাতনে সহায়তার বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন উপরোক্ত তিন ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের বিরুদ্ধে । এ ছাড়া তারা ছাত্র নির্যাতনের বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার ও উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
আবরার হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া, ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, সিসিটিভি ফুটেজ ধ্বংস করা এবং আবরারকে শিবির প্রমাণের চেষ্টা করে ছাত্রলীগ। এ কাজে প্রশাসন সহায়তা করে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক শিক্ষার্থী। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের কারণে তাদের এসব হীন চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
আবরার হত্যার সময় বুয়েটের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ছিলেন ড. মিজানুর রহমান। ড. মিজানুকে বারবার ফোন এবং মেসেজ করেও জবাব পাওয়া যায়নি।
আবরার হত্যার সময় শেরে বাংলা হলের প্রোভোস্ট ছিলেন গণিত বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল খান। তখন বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বর্তমানে বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় এআইইউব’র উপাচার্য।
ছাত্রলীগের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার কয়েক শিক্ষার্থী আমার দেশকে বলেছেন, প্রশাসনের দায়িত্ব ক্যাম্পাসে সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বছরের পর বছর ধরে বুয়েটে ছাত্রলীগ যে পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছে সে বিষয়ে পুরোপুরি অবগত ছিল বুয়েট প্রশাসন। কিন্তু তারা ছাত্রলীগের এ বর্বরতা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। এমনকি বিভিন্ন হলের টর্চার সেলে সারারাত পেটানোরত অবস্থায়ও দায়িত্বরত শিক্ষকদের কাছে অন্য শিক্ষার্থীরা ছুটে গিয়েও সাড়া পাননি।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেছেন, প্রশাসন চাইলে কোনো অবস্থাতেই ছাত্রলীগ এ ধরনের নির্যাতন চালাতে পারত না এবং আবরার হত্যার মতো কলঙ্কিত ঘটনা ঘটত না । সন্ত্রাসী সংগঠনটিকে দানবীয় রূপে আবির্ভূত হতে সহায়তা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসিনক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ছিলেন মূলত আওয়ামী লীগের। প্রশাসনের পদে থেকে তারা ছাত্রলীগকে সহায়তা করেছে শিবির দমনের নামে ধার্মিক শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতন এবং বুয়েটে তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের জন্য। বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের জন্য ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট হলের প্রভোস্ট এবং অনেক হাউস টিউটরদের নীরবতাকেও দায়ী করেছেন।
আবরারের ছোট ভাই ফাইয়াজ আবরার আমার দেশকে বলেন, আবরার হত্যা এবং তার আগে বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় প্রশাসনের দায় আছে।
ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার বুয়েটের শিক্ষার্থী ইকবাল মাহমুদ বলেন, প্রশাসনকে জানানো হলে তারা উল্টো নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করত।
নির্যাতনের শিকার এনামুল হক বলেন, বুয়েটে ছাত্রলীগের পৈশাচিক নির্যাতনে প্রশাসনের যে সহায়তা তা শুরু হয় উপাচার্য নজরুল ইসলামের হাত ধরে। তিনি ২০১০ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত বুয়েটের উপাচার্য ছিলেন। নজরুল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন তার লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে।
উপাচার্য নজরুলকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠালেও দেননি কোনো জবাব।
বিভিন্ন সময়ে আড়িপাতার সেই তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে জড়িত থাকায় ছাত্রলীগের যে সব সন্ত্রাসীর নামে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ অথবা মামলা করেছেন তারা হলো- রওনক আহসান (সিএসই’০৪), ফাইরুজ চৌধুরী (সিভিল’০৬), আমিনুল হক পলাশ (কেমিক্যাল’০৬), তন্ময় আহমেদ (সিভিল০৭), তানভীর মাহমুদ আরাফাত (সিএসই’০৭), ইমরান হোসেন (ডাব্লিউআরই’০৭), সাইফুল্লাহ সিকদার মিঠুন (এমএমই০৮), সুজিত সাহা (এমএমই’০৮), শুভ্র জ্যোতি টিকাদার (মেকানিক্যাল’০৯), আরিফ রায়হান দিপ (মেকানিক্যাল’০৯), সিয়াম হোসেন (মেকানিক্যাল’০৯), আবু আনাস শুভম (মেকানিকেল’০৯), আরিফুর রহমান কাজল (সিভিল’০৯), জয় প্রকাশ রায় (কেমিক্যাল’০৯), আবু সাইদ কনক (মেকানিক্যাল’১০), সাদমান প্রতীক (সিভিল’১০), শিহামুজ্জামান শান্ত (সিভিল’১০), সৌম্য কান্তি দাশ (ইইই’১০), আনোয়ার হাবিব অনিক (সিভিল’১০), প্রতীক দত্ত (ইইই’১১), অনির্বান সাহা (সিভিল’১১), শেখ তানভীর রায়হান (সিভিল’১১), আহসান উল্লাহ (মেকানিক্যাল’১১), মাহমুদুল হাসান সাগর (নেভাল’১১), অনুপ কুমার বিশ্বাস (ইউআরপি’১১), আকাশ দেবনাথ (সিভিল’১২), জামিউস সানি (মেকানিক্যাল’১২), অভিজিত সাহা নয়ন (সিভিল’১২), দেবদ্যুতি সরকার (সিভিল’১২), শাফায়েত চৌধুরী জয় (সিভিল’১২) ও ইমতিয়াজ হোসেন (সিভিল’১২)।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আবরার হত্যার জন্য ছাত্রলীগের ২৫ জনের সাজা হয়েছে। কিন্তু আবরার হত্যা এবং তার আগে ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের যে পৈশাচিক নির্যাতনের জন্য আড়িপাতা গ্রুপের অনেক সদস্য এবং বুয়েট প্রশাসন দায়ী হলেও তারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীদের অনেকে।