ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতের আশ্রয়ে আছেন। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিসরি গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরের পর দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিক্রম মিসরির কাছে জানতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে কোন মর্যাদায় আছেন? তবে এ বিষয়ে মিসরি কী বলেছেন, তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে শেখ হাসিনা ভারতের মেহমান হিসেবেই নাকি আছেন। এর আগে গত নভেম্বরে নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সাওয়ালের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাকি নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করছে ভারত’। এমন প্রশ্নের জবাবে ভারত সরকারের অবস্থান তুলে ধরে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘আমরা এখান থেকে ইতোমধ্যে বলেছি, তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের এটাই অবস্থান।’
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার বিভিন্ন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার প্রতিটি বক্তব্যই ছিল হিংসাত্মক, আক্রমণাত্মক ও ধ্বংসাত্মক। সর্বশেষ গত ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। কারণ সাড়ে ১৫ বছর জেলহাজত গুম-খুন-আতঙ্কে জিম্মি ছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। সেই জিম্মিদশা থেকে গত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেড় হাজারের বেশি মানুষের জীবন আর ২০ হাজারের বেশি মানুষের পঙ্গু হওয়ার বিনিময়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।
তবে পরিতাপের বিষয় হলো, শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার পরও শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা নেই, বরং তাদের ভেতরে জ্বলছে ক্ষমতা হারানোর প্রতিশোধের আগুন। এর প্রমাণ শেখ হাসিনার প্রচারিত হওয়া প্রতিটি অডিও ক্লিপ। প্রতিটি অডিও বার্তায় তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের প্রতিশোধ নিতে সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ও তাদের হত্যার নির্দেশ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি বাংলাদেশে স্বৈরাচারের আঁতুরঘর অভিহিত করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বাড়ি, দলের অফিস ও শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়।
তবে শেখ হাসিনার বক্তব্যকে তার ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ আখ্যা দিয়ে এর জন্য ‘ভারত দায়ী নয়’ বলে দাবি করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। অর্থাৎ ভারত শেখ হাসিনার বক্তব্যের দায় নিচ্ছে না। তবে ভারতের মাটিতে আশ্রিত হয়ে দেশটির প্রযুক্তি ব্যবহার করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ধরনের ষড়যন্ত্র ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছেন, এর দায় ভারত সরকার এড়াতে পারে না।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে এবং শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বারস্থ হন। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গত জুলাই-আগস্টের বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রসঙ্গটি আনলে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়িত্ব নরেন্দ্র মোদির ওপর ছেড়ে দেন। যদিও ভারত এবং বাংলাদেশের একশ্রেণির দালাল মিডিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যার তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করে তাকে ও এই গণহত্যায় জড়িত তার দোসরদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের এই তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটনের সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হোয়াইট হাউসের সামনের সড়কে মোদির গুণগান ও বাংলাদেশবিরোধী নানা স্লোগান দিয়েছেন। তাদের এই আচরণ প্রমাণ করে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের জুলাই গণহত্যার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই। তারা দেশের জনগণের চেয়ে ভারতীয় প্রভুদের খুশি রাখতেই ব্যস্ত। তাদের এমন আচরণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নÑভারত কি পারবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসন করতে? হাসিনা গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে জাতিসংঘের তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর ভারতের সামনে কি সেই সুযোগ আছে?