সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ছোট ভাই ফোন করে বলে দিয়েছিল যেন বড় ভাই আরিফুল ইসলাম রাজীব বাসা থেকে বের না হন। তবে কেউ থামাতে পারেননি রাজীবকে। ২০ জুলাই রাজীবের স্ত্রী শরীফা বেগম জানতে পারেন, আন্দোলনে গিয়ে বোর্ড বাজার এলাকায় তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পরে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে, কিন্তু রাজিবের পরিবারে নেমে এসেছে দুর্দিন। রাজিবের বাবা এখন ভিক্ষা করে সংসার চালান।
রাজীব ছিলেন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী। থাকতেন গাজীপুর সদরের বোর্ড বাজার এলাকায়। আদর্শনগর বটতলায় ভাঙাড়ির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। প্রতিদিনের মতো ২০ জুলাই সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। দুপুরে বাসায় আসেন। খাবার খেয়ে ১০০ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হলে স্ত্রী শরীফা যেতে বাধা দেন। কিন্তু বাধা শোনেননি। চলে যান আন্দোলনে। অতঃপর গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
শরীফার কাছে তখন কোনো টাকা ছিল না। স্বামীর লাশ কীভাবে মতলব উত্তরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন, সে চিন্তায় পড়ে গেলেন। পরে বোর্ড বাজার এলাকার লোকজনের সহায়তায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে গ্রামের বাড়ি মতলব উত্তরের গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজে নিয়ে আসেন। পাশের রাঢ়ীকান্দি গ্রামের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
রাজিব ওই গ্রামের রজ্জব আলী বেপারীর বড় ছেলে। তার ডান হাত অকেজো হয়ে যাওয়ায় ৪ বছর যাবৎ কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে ভিক্ষা করে সংসার চালান। তাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বড় ছেলে রাজীব। রজ্জব আলীর ৪ মেয়ে ২ ছেলে। ৩ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন।
সংসারে অভাব থাকায় ছোট মেয়ে সুমি ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর লেখাপড়া করতে পারেনি। সে অবিবাহিত। ছোট ছেলে ফয়েজ (১৯) স্থানীয় ওটারচর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ফলে ৬ সদস্যের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ফয়েজ। সে এখন চাঁদপুরের একটি হোটেলে সামান্য বেতনে বয়ের কাজ করে।
শহীদ রাজীবের মা রাহিমা বেগম (৫১) আমার দেশকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মৃত্যুর আগের দিন রাতে আমার ছেলেকে মোবাইলে ফোন দিছিলাম। আমার ছেলে কয়, মা আমি যদি মইরা যাই, আমার ছেলেডারে দেইখা রাইখো। অরে এতিম কইরো না। আমি কই, বাজান কী কস। তুই কেন মইরা যাবি। আমার ছেলে কয়, মা হায়াত-মউতের কথা তো কওন যায় না। পরদিন শুনতে পাই আমার জাদুমণি গুলি খাইয়া মইরা গেছে।’
কান্নারত অবস্থায় তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এহন আমারে কে মা বইল্লা ডাকব? আমার ছোডো পোলাডারে যদি সরকার একখান চারকি দিত, তয় আমাগো সংসার ভালো চলত।’ তিনি বলেন, ‘কী কমু, আমার স্বামী ভিক্ষা কইরা আমগো সংসার চালায়। দৈনিক ৩-৪ কেজি যা চাউল পায়, তা দিয়াই আমগো সংসার চলে।’
শহীদ রাজীবের স্ত্রী শরীফা বেগম (২৪) আমার দেশকে বলেন, ‘যেরা আমার স্বামীরে মাইরালাইছে, আমি হেগো ফাঁসি চাই।’ তিনি জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তাদের ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। সে টাকা ব্যাংকে রাজীবের ছেলে ইব্রাহীমের নামে স্থায়ী ডিপোজিট করে রেখেছেন। ইব্রাহীমের বয়স আঠারোর আগে ওই টাকা কেউ উত্তোলন করতে পারবে না। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী দিয়েছে ২ লাখ টাকা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুরের গাছা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুমন খান আমার দেশকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চালাকালীন গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরিফুল ইসলাম রাজিব মারা যান। তখন ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করা হয়েছিল। পরে এ ঘটনায় তার বাবা রজ্জব আলী বেপারী বাদী হয়ে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহাঙ্গীর আলমসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যামামলা দায়ের করেন।
মতলব উত্তর থানার ওসি মো. রবিউল হক আমার দেশকে জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়া রাজিবের লাশ রাঢ়ীকান্দি কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। ফলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন চিফ জুডিশিয়াল আদালত মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আদেশ দেয়। গত ১৮ ডিসেম্বর সকালে রাজীবের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে লাশ পুনরায় রাঢ়ীকান্দি কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।