৫ আগস্ট সকালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকা শহর ছিল উত্তাল। প্রতিবাদমুখর ছাত্র-জনতা রাজধানীর বাড্ডায় মিছিল করছিল। তাতে অংশ নেন কাজী ফারুক। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছোড়ে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। রাবার বুলেট ও ছররা গুলিতে আহত হন কাজী ফারুক (৪০)। তার দুই চোখেই অন্ধকার নেমে আসে।
অসংখ্য ছররা গুলি মাথায়, মুখে, চোখে লেগে ক্ষত হয়ে যায় শরীর। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। চার-পাঁচ দিন পর জ্ঞান ফিরলে দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন ফারুক। প্রায় তিন মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
কাজী ফারুকের বাবা মারা গেছেন তার জন্মের দু মাস আগে। মা মারা গেছেন তাও বছর ১৫ হবে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ফারুক নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। স্ত্রী-সন্তান না থাকায় ঢাকার পশ্চিম মেরুল বাড্ডায় ব্যাচেলর মেসে থাকতেন। সামান্য বেতনে সেখানকার একটি ক্লাবে কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্র-জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন ফারুক। হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে বড় ভাইয়ের বাড়িতে থেকেই বাকি চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সেদিনের কাহিনী তুলে ধরেন কাজী ফারুক। তিনি বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আমি অংশ নিয়েছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট আন্দোলনে অংশ নিতে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। মেরুল বাড্ডা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিপরীত পাশের বাড্ডা থানা থেকে ছাত্র-জনতার উদ্দেশে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়া হচ্ছিল, যা দেখে আমি থানার দিকে এগিয়ে, পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বললাম, আপনারা গুলি করছেন কেন?
তখন তারা বলে, গুলি না করলে তো ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। তখন আমি তাদের বলি, আপনারা গুলি কইরেন না, কেউ আপনাদের কিছু বলবে না। তারাও বলে ঠিক আছে, আর গুলি করব না। তখন আমি ১০/১২ কদম এগিয়ে ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ করে বলছিলাম, পুলিশ আর গুলি চালাবে না বলে জানিয়েছে। এই কথা বলার সময়ই আমার বাম পাশ থেকে এক বয়স্ক পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে ছররা গুলি ছোড়ে।
আমার মাথায় ও চোখে অসংখ্য ছররা গুলি লাগে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা আমাকে নিয়ে যায়। আমার মাথায় এখনো একশর বেশি গুলি আছে, এগুলো বের করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
ডাক্তার বলেছেন, আমার বাম চোখ পুরোই বাদ, এটা ফেলে দিতে হবে। ডান চোখে লাইট পাচ্ছি, কয়েকদিন আগে প্রায় ৮৬ হাজার টাকা খরচ করে একটি অপারেশন করিয়েছি; কিন্তু কোনো সুফল পাইনি। তিন মাস পর আরেকটা অপারেশন করতে হবে, সেই অপারেশন সাকসেস হলে হয়তো ডান চোখে আবার দেখতে পাব।
ধানমন্ডির হারুন আই ফাউন্ডেশন হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসানের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন ওষুধ খাচ্ছি, একবেলা ওষুধ না খেলে পাগলের মতো হয়ে যাই। তাকে গুলি করা সেই পুলিশের চেহারা কখনোই ভুলতে পারবেন না বলেও জানান ফারুক।
চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে দেড় লাখ টাকা অনুদানও পেয়েছেন বলে জানান ফারুক। আরো দেড় লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যদিও বেশ কয়েকবার জুলাই ফাউন্ডেশনে গিয়েও চিকিৎসার ব্যয় বহনের সেই অর্থ পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
আহত হওয়ার আগে, পশ্চিম মেরুল বাড্ডায় ব্যাচেলর হিসেবে একটি মেসে ভাড়া থাকলেও আহত হওয়ার পর থেকে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
ফারুকের বড় বোন বলেন, চোখে ও মাথায় গুলি লাগার পর দীর্ঘ ছয় মাস ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছে আমার ছোট ভাই। প্রতিদিন দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আমাদের ভাই। ডান চোখের আলো ফিরে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। সে আশায় দিন গুনছে ফারুক, দিন গুনছি আমরাও।
নারায়ণগঞ্জ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আহতদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন তারা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আহত এবং নিহতদের তালিকা করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এদের জন্য সরকারি সহযোগিতার চেষ্টা করে যাচ্ছি।