# অভাবের সংসারে একমাত্র ভরসা ছিলেন নুর
# পুলিশের গুলি পিঠে লেগে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়
# ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্ট্রোক করেন মা
অভাবের সংসারে একমাত্র ভরসা ছিলেন নুরে আলম সরদার (৪৫)। পেশায় ছিলেন হকার। রাজধানীর উত্তরায় ভ্যানে করে বিক্রি করতেন পুরাতন কাপড়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে ১৬ জুলাই ভ্যানটি রাস্তায় রেখে বাসায় চলে আসেন। এরপর গত ১৯ জুলাই ভ্যানটি রাস্তায় সাইড করে রেখে আসার জন্য উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় যান তিনি। সেখানে যাওয়ার পর পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট তার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নুরে আলম। আশপাশের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাকে দ্রুত বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে বিকাল ৫টার দিকে সেখানেই মারা যান তিনি। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার কুলকুড়ি গ্রামে।
জানা যায়, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে অভাবের সংসারের হাল ধরতে হয় নুরে আলম সরদারকে। এজন্য লেখাপড়া করতে পারেননি। রাজধানীর ফুটপাতে পুরোনো কাপড় বিক্রি করে স্ত্রী, একমাত্র ছেলে ও মাকে নিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার। তবে হঠাৎই সবকিছু শেষ করে দেয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট। এদিকে ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই স্ট্রোক করে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে যান তিনি। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থেকে গত ৬ জানুয়ারি না ফেরার দেশে চলে গেছেন নুর।
আমার দেশকে নুরে আলমের স্ত্রী জহুরা বেগম (৩৫) বলেন, তার স্বামী দৈনিক ৫০০ টাকা বেতনে উত্তরায় ভ্যানে করে আরেকজনের দোকানের পুরাতন কাপড় বিক্রি করে দিতেন। আন্দোলনের কারণে ভ্যানগাড়িটি রাস্তায় রেখে বাসায় চলে আসেন তিনি। তিন দিন আমরা তাকে ঘর থেকে বের হতে দিইনি। শুক্রবার বলেন, ‘আমি আরেকজনের দোকান খোলা রেখে আসছি। যদি কিছু হারায়, তাহলে আমাকে জরিমানা দিতে হবে। আমি গিয়ে দোকানটা সাইড করে রেখে আসি।’
বাইরে এ সময় বিভিন্ন স্থানে গণ্ডগোল হচ্ছিল। আমাদের বাড়িওয়ালাসহ অনেকেই তাকে যেতে নিষেধ করেছেন। আমার ছেলেও ফোন করে তার বাবাকে বলেছিল, আমি উত্তরা থেকে আসতে পারছি না বাবা, তুমি এসো না। জহুরা বলেন, কিন্তু তিনি বারবার বলছিলেন কিচ্ছু হবে না, ভ্যানগাড়িটি সাইড করে রেখেই চলে আসবেন।
কিন্তু সেটাই তার শেষ যাওয়া হবে কে জানত। তিনি ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন। পরিবার নিয়ে ছিল তার কত স্বপ্ন। আজ তার সব স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। স্বামীর ইনকাম দিয়ে সংসার চলেছে আমাদের। আর আজ আমি অসহায়, দেখার কেউ নেই। জহুরা বেগম তাই বাধ্য হয়ে গার্মেন্টে চাকরি করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন।
জহুরা বেগম আরও বলেন, অভাবের সংসারে ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই তাদের। গত ১৫ বছর ধরে গাজীপুরে ৬ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকছেন তারা। এখানে দীর্ঘদিন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজও করেছেন তার স্বামী। পরে এটা ছেড়ে আরেকজনের দোকানে পুরাতন কাপড় বিক্রির কাজ শুরু করেন। একমাত্র ছেলে ইমনের বয়স এখন ২১ বছর। অভাবের কারণে এসএসসি পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি তার। বর্তমানে হেলপার হিসেবে কাজ করে সে।
আর্থিক সহযোগিতা হিসেবে সরকারের ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানান জহুরা বেগম। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টাকাগুলো ব্যাংকে রেখেছেন। সরকারের কাছে তার দাবি, তাদের যেন পুনর্বাসন করা হয়।
জহুরা বেগম বলেন, আমি শেখ হাসিনার বিচার চাই। তার বিচার করতেই হবে। আজ হোক আর পাঁচ বছর পরে হোক, তার বিচার হতেই হবে।
শহীদ নুরে আলমের একমাত্র ছেলে ইমন বলেন, ‘বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমি ভালো কিছু করব। আমার আর ভাইবোন না থাকায় আমাকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন ছিল। বাবা চলে গেছেনÑ এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়। আম্মুও এতিম, আমিও এতিম। আমার বাবা প্রতিদিন আমার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে আসতেন। রাতে যখনই বাসায় আসতেন, আমাকে জাগিয়ে আদর করতেন। আল্লাহর কাছেই বিচারের ভার দিয়েছি। তিনিই এর বিচার করবেন।’