সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন

শাহবাগের বিভাজন ও খুনের সংস্কৃতি

রিপোটারের নাম / ৫৬ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

সরোজ মেহেদী
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫, ১১: ১৯

দুই হাজার তেরো সালে হুট করে গজিয়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ শুধু ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলে সমস্যা ছিল না। বিচার পাওয়া বা চাওয়ার অধিকারকে মানুষমাত্রই স্বীকার করে। কিন্তু সে সময় শাহবাগে তা হয়নি। বরং একদল রাষ্ট্রীয় মদত ও সমর্থনে বিশৃঙ্খল মব সৃষ্টি করে আরেক দল মানুষকে খুনের আয়োজন করেছিল। তারা যা চাইছিল, তা বিচার ছিল না। ছিল বিচারব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জোর-জবরদস্তি। এই আধুনিক যুগে এসে একটি দেশের রাজধানী শহরে ঠিক মানুষের মতোই দেখতে একদল মানুষের এই যে আরেকজনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আবদার বা জোরাজুরিÑ ঠিক এটাই শাহবাগে ঘটেছিল। শাহবাগের সেই মঞ্চ ‘গণ’ নাম দিয়ে একটি জনপদের জনের মধ্যে বিভেদের একটা রেখা টেনে দিয়েছিল। এ রেখা এর আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও নানাভাবে ঘটবে। কিন্তু শাহবাগের মতো এমন আনুষ্ঠানিকভাবে আর কেউ করেনি।

আজ বাংলাদেশে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন, তার রাষ্ট্রীয় সূচনা হয়েছিল শাহবাগে এবং সে সময়কার শাসক সে মঞ্চকে ব্যবহার করেছিল তার ক্ষমতার খায়েশ দীর্ঘায়িত করতে। শাহবাগের সেই ক্ষত আজ এত বছর পরও মেটেনি, বরং আরো দগদগে হয়ে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

এমন এক বাইপোলার দেয়াল শাহবাগ তৈরি করেছে, তা আদৌ কোনো দিন ভাঙা যাবে কি না, আমরা আজও জানি না। এতটা নির্লজ্জভাবে এত মানুষ নিয়ে কাউকে জবাই করার ও কবর দেওয়ার মতো বীভৎস স্লোগান এভাবে আর কখনো বাংলাদেশে দেওয়া হয়েছিল কি না, তাও আমাদের জানা নেই। কী অবলীলায় তারা বলছিলÑ ‘ফাঁসি দে, কবর দে’। এর আগেও অনেকে রাজপথে ফাঁসির স্লোগান দিয়েছে। তবে সেসব ছিল নিতান্তই রাজনৈতিক চটকদারি। কিন্তু এই প্রথম আমরা দেখি, বিচারব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে সত্যি সত্যিই ফাঁসির আয়োজন করতে। আর সবকিছু উচ্ছৃঙ্খল মব যেভাবে চাচ্ছিল, সেভাবেই হচ্ছিল।

এই শাহবাগ তথা গণজাগরণ মঞ্চের অনেক অপরাধ। অনেক দায়। এই সমাজ ও দেশের কাছে প্রায়শ্চিত্ত করার মতো অনেক কিছু আজও রয়ে গেছে তার। আমি মোটা দাগে দুটি বিভক্তি ও একটি ধ্বংসের কথা বলি। নিজের শৈশবের দিকে তাকালে দেখি, আমরা এমন একটা সমাজে বেড়ে উঠেছি, যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল, বিএনপি ছিল, কোথাও কোনো একটা দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সঙ্গে জামায়াত, জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো দলের অল্পসংখ্যক উপস্থিতি। বাম দলগুলোর উপস্থিতি বা সমর্থন গ্রামের দিকে তুলনামূলক কম চোখে পড়েছে। সব দল বা ধর্ম মিলে আমরা শেষ পর্যন্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে বসবাস করেছি। বাবা লীগ আর পাশের ঘরে চাচার দল করার যে রসায়ন, যে ভারসাম্য, তা শাহবাগ তথা শাহবাগের তথাকথিত জাগরণ চিরতরে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। শুধু রেখে গেছে রক্তের দেয়াল। শাহবাগের এ আন্দোলন শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। আর স্বৈরাচার এমন কিছু নেই, যা ধ্বংস করে না। সে জনপদে আগুন দেয়, বন কেটে খালি করে, পুকুরের মাছ মারে, সাগর ভরাট করে ভবন তোলে। হাজার হাজার লাশ নদীর তলে গোপন করে। আয়নাঘরে শত শত মানুষকে বন্দি করে রাখে। যা যা ভালো, সব ধ্বংস করে, সবকিছুতে বিভাজন তৈরি করে সে টিকে থাকতে চায়। ফলে সামাজিকতা ও সৌহার্দ্য বলে যে বিষয়গুলো ছিল আমাদের ঐতিহ্য, তা অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। এর সূচনাও কিন্তু শাহবাগ থেকে।

শাহবাগ আমাদের ধ্বংস হতে হতে কোনো রকমে টিকে থাকা স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে হুতুম প্যাঁচার মতো ধ্বংস করে ছেড়েছিল। এমন এক মব সেখানে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমনসব আবদার উত্থাপন করা হচ্ছিল, ফলে বিচারের আর দরকার ছিল না। বিচারকরা শাহবাগের দিকে তাকিয়ে রায় লেখা শুরু করে। শাহবাগ আরো মাথায় চড়ে বসে। তাদের আবদার লম্বা থেকে আরো বেশি লম্বা হতে শুরু করে। স্বৈরাচার লাভের গুড় ঘরে তুলতে আশকারা দেওয়া শুরু করে। এরপর আমরা বিচারের নামে দেখি বিচারহীনতার এক লম্বা ফিরিস্তি। সকাল-বিকাল শাসকের প্রয়োজনে বিচারক পরিবর্তিত হতে বা বিচারককে শাসকের মর্জি বুঝে চলতে। এর আগে কোনো শাসক বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে এতটা হস্তক্ষেপ আর করেনি। অন্তত ১৯৯১ সালের পর তো না-ই।

শাহবাগ আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিচারিক সংস্কৃতিতে একটা পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। আমি বয়স হওয়ার পর প্রথম শাহবাগে দেখেছিÑ একদল মানুষ আরেকদল মানুষের অধিকার হরণ করে, বেইজ্জতি করে, ইজ্জত নিয়ে উল্লাসে মাততে। রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী গ্রুপ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীÑ সবাই এদের মদত দেয়। এই যে শুরু, তার পরের ১২ বছরে খুন করা হয় হাজার হাজার মানুষকে। কত শত মা-বোনের ইজ্জত হরণ করা হলো? রাষ্ট্রীয় প্ররোচনায় দলগত ঘৃণার উৎপাদন হয়েছিল সে সময়। স্বাভাবিক করা হয়েছিল একটি বিশ্বাসের মানুষের ওপর চলা সব ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনকে। এর শুরুটা ছিল আসলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ।

ছোট বাচ্চাদের এনে ঘৃণা, খুন এসব শেখানো হয়েছিল। এরা সেদিন ‘ফাঁসি চাই, কবর দে, জবাই কর’ বলে বুনো উল্লাসে মেতেছিল। অথচ এসব স্লোগান ফ্যাসিবাদী। এগুলো অসভ্যতা। একটি দেশের সামাজিক ও বিচারিক ভারসাম্যকে নাই করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে খারাপ স্লোগান আর হয় না। তারা সেটাই করেছিল।

প্রতিটি অপরাধ ও খুনের বিচার হওয়া জরুরি। ৭১ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিচার চাওয়ার বিরোধিতা কোনোকালেই করিনি। কিন্তু বিচারের নামে স্রেফ খুন করাকে আপনি সমর্থন করবেন কি না, তা আপনার বিবেচনা। আমি করি না।

শাহবাগ তথা গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত করা এবং এর কুশীলবদের আইনের আওতায় আনার এটাই সময়। আমরা আর কোনো জাগরণ বা গণজাগরণের নামে খুনের মঞ্চ দেখতে চাই না। আমরা একটি স্বাভাবিক বাংলাদেশ চাই। আমার কাছে ‘শাহবাগি’ বা ‘শাপলা’ বড় ইস্যু নয়। আমি এমন একটি সমাজ কল্পনা করি, যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ সহাবস্থান করতে পারবে। আমি শান্তি চাই, সহনশীলতা চাই। আমি এমন একটি সামাজিক কাঠামো চাই, যেখানে ভিন্নমত থাকলেও একজন ব্যক্তির জীবনের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। এমনকি লেখক জাফর ইকবালের মতো ব্যক্তিরওÑ যাকে আমি মানুষ হিসেবে পছন্দ করি না। আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধঃপতনের পেছনে এই লোকটার কপটতা ও ভণ্ডামি দায়ী বলে মনে করি, তবে তারও স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার থাকবে। সেখানে আমি কথায় কথায় ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর’ স্লোগান শুনতে চাই না। শাহবাগে বিচারহীনতা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, আমরা চাই জুলাই-২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ সে অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসুক। শাহবাগের কাফফারা ‘শাহবাগি’দের পালটা জবাই করা/ফাঁসি দেওয়ার স্লোগান দিয়ে হবে না! হবে সহাবস্থানের নতুন বন্দোবস্তে আর ভিন্নমতাবলম্বীকে ট্যাগের রাজনীতি বন্ধ করার মধ্য দিয়ে।

লেখক: সাহিত্যিক। শিক্ষক, গণমাধ্যম অধ্যয়ন ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)

কেন্দ্রীয় সদস্য: জাতীয় নাগরিক কমিটি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ