সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৪২ অপরাহ্ন

সংসদের আগে হচ্ছে না স্থানীয় নির্বাচন

রিপোটারের নাম / ৬৯ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : বুধবার, ৫ মার্চ, ২০২৫

এমরান এস হোসাইন
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৫, ১০: ৩৩

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হচ্ছে না স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে অনুষ্ঠানের একটি চিন্তা অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে তৈরি হলেও তা থেকে সরে এসেছে। এ বিষয়ে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা এবং একই সঙ্গে তাদের দ্রুত সংসদ নির্বাচনের চাপসহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে আয়োজক সংস্থা নির্বাচন কমিশনেরও সায় নেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের। কমিশন বলেছে, তাদের মেইন ফোকাস সংসদ নির্বাচন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আগাগোড়াই সংসদ নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির কথা বলে আসছেন। তবে সারা দেশে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় জনগণের সেবাবঞ্চিত হওয়াসহ মাঠ প্রশাসনের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে অনুষ্ঠানের নতুন চিন্তা তৈরি হয়। এ সময় অংশীজনের থেকেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে অনুষ্ঠানের পরামর্শ আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফ থেকে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

গত ৮ জানুয়ারি ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে।

পরদিন এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জনগণ কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবাগুলো না পাওয়ার কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চিন্তা এসেছে উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নাগরিকদের এই সেবা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ নিয়ে অগ্রসর হতে পারব।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গত ডিসেম্বরের ২০ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত যে জনমত জরিপ করে, তাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে জোরালো মত আসে। জরিপে অংশ নেওয়া নাগরিকদের ৬৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব স্তরের নির্বাচন করার পক্ষে মত দেন। পরে সংস্কার কমিশনও তাদের সুপারিশে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে বলে। সংস্কার কমিশনের এ সুপারিশ সরকারের চিন্তাকে আরো বেগবান করে।

এদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের পরিকল্পনার তথ্য ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভক্তি তৈরি হয়। বিএনপি, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও তাদের মিত্ররা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোর বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তিÑ এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ঘিরে ‘রক্তপাত এবং বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির আশঙ্কার কথাও জানায় তারা। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনাকে তারা দুরভিসন্ধিমূলক বলেও অভিযোগ তোলে। অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীর), ছাত্র অধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির (বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি) অবস্থান এর বিপরীতে। তারা সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তোলে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করে।

ওই বৈঠকের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় জনপ্রতিনিধিরা নেই। এ কারণে তার ব্যক্তিগত মত জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করাটা ভালো হবে। কারণ সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেয়নি। খুব দ্রুত কোনো একটা সিদ্ধান্ত আসবে। হয় আমরা দ্রুত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করব, অন্যথায় প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশের যে সারসংক্ষেপ সরকারের কাছে জমা দিয়েছে, তাতে আগামী জুনের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. তোফায়েল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, আমরা মনে করি স্থানীয় সরকার নির্বাচন জুনের মধ্যে সম্ভব। সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনরা সংসদ নির্বাচনের আগে বা পরে যখন চায় তখন হতে পারে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যদের বিপরীতমুখী অবস্থান এখনো রয়েছে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আলাদাভাবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করেও তাদের নিজ নিজ অবস্থান জানিয়ে এসেছে।

গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জনদুর্ভোগ কমাতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। এর আগের দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিকরা বিশ্বাস করেন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের.. এবং গণহত্যা, অর্থপাচার এবং মাফিয়া কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ীদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দেবে।

নির্বাচন আয়োজক সংস্থা নির্বাচন কমিশনও সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে নয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ধামরাইয়ে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাসুদ বলেন, আমাদের এখন মেইন ফোকাস হচ্ছে সংসদ নির্বাচন। আমরা এই মুহূর্তে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। যদি আমরা এই মুহূর্তে স্থানীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করি, তাহলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এদিকে সরকারের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও মাঠপর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে সরকারকে এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার সুপারিশ করেছে। তাদের সুপারিশে বলা হয়, এই মুহূর্তে স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন হলে পতিত স্বৈরাচার সরকারের দোসররা সুযোগ নেবে। এতে রক্তপাতসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।

রাজনৈতিক দলের বিভক্তি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থানের জের ধরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্রের সঙ্গে আলাপকাল জানা যায়, সার্বিক বিবেচনায় সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনা থেকে কিছুটা পিছু হটছে। সরকারের সূত্র বলেছে, নানাবিধ কারণে সরকার এমনিতেই চাপে রয়েছে। এরই মধ্যে বড় একটি অংশীজন বিশেষ করে বিএনপির বিরোধিতার মুখে স্থানীয় নির্বাচন করতে গেলে জটিলতা আরো ঘনীভূত হবে।

এ নির্বাচন করতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে, যা জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমার ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। এসব যৌক্তিকতা বিবেচনা করে এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিয়েছে সরকার। এর পরিবর্তে স্থানীয় সরকাররের সব স্তরে প্রশাসক নিয়োগের চিন্তা করছে সরকার। এর অংশ হিসেবে সিটি করপোরেশনগুলোয় নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ছাড়াও এসব পরিষদে রাজনীতিকসহ সমাজের বিশিষ্টজনদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সচিব নিজাম উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি আমি অবহিতও নই।

সচিব আরো বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনগুলোয় নতুন করে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুয়েকটি নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সিটিতেও আমরা প্রশাসক নিয়োগ করব। সিটি করপোরেশন ছাড়াও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের চিন্তা রয়েছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কীÑ জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ