বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৮ অপরাহ্ন

সংসদের বাইরে এমপিদের ‘খবরদারি’ চান না ডিসিরা

রিপোটারের নাম / ৮৭ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

জনপ্রতিনিধিদের জন্য আচরণবিধি করার প্রস্তাব

এম এ নোমান
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৫৪

আইন প্রণয়নের বাইরে সংসদ সদস্যদের (এমপি) সব ধরনের ‘খবরদারি’ বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। পাশাপাশি তারা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা মেয়রসহ সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির জন্য আচরণবিধি করার কথাও বলেন। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন তারা।

মাঠপর্যায়ে সরকারের নীতি বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এমপিদের হস্তক্ষেপ বন্ধের প্রস্তাবের বিষয়ে একজন জেলা প্রশাসক আমার দেশকে জানান, সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন জাতীয় সংসদে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থেকে দেশ পরিচালনায় আইন প্রণয়নের জন্য। বর্তমান বাস্তবতায় তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের সব ধরনের নিয়োগ, পদায়ন ও জলমহাল ও হাটবাজার ইজারা থেকে সব কাজে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করে আসছেন। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাইরেও এমপিদের নামে রাজনৈতিকভাবে রাজস্ব খাত থেকে বিশেষ বরাদ্দ ও থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। সবকিছুতে এমপিদের খবরদারি করা একটি অঘোষিত রীতিতে পরিণত হয়েছে বলেও জানান ডিসি।

তিন দিনব্যপী সম্মেলনের কার্য অধিবেশন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে চলছে। গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার কার্যালয়ে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। আজ মঙ্গলবার সম্মেলনের শেষদিন। সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে ডিসিরা এক হাজার ২০০-এর বেশি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যাচাই-বাছাই করে ৩৫৪টি প্রস্তাব আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য গ্রহণ করেছে।

এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের আচরণ বিধিমালা

এবারের ডিসি সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের আচরণবিধিমালার প্রস্তাব। প্রস্তাবটি পেশ করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। এ প্রস্তাবের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ বলেছেন, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারের নীতি বাস্তবায়ন ও সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার দয়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। গত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে দেশবাসীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তা ছিল বড়ই বেদনাদায়ক। নিপীড়কের ভূমিকায় থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে তারা অবাঞ্ছিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন। এসব কারণে জেলা প্রশাসকরা সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের জন্য আচরণবিধিমালা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

এ প্রস্তাবের বিষয়ে সম্মেলনে অংশ নেওয়া আরেকজন ডিসি জানান, ‘সংসদের বাইরে এমপিদের আর কোনো কাজে সম্পৃক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এমনও দেখা গেছে, এলাকায় এমপি গেলে ডিসি তার সঙ্গে দেখা করতে না গেলে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোট পদেও এমপির পছন্দের লোককে নিয়োগ দিতে হয়েছে। এতে যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে। কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার সময় এমপির পছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে দুর্নীতি প্রাধান্য পেয়েছে, আর জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে। বালুমহাল, হাটবাজার ও জলমহাল ইজারা দেওয়ার সময়ও এমপিরা স্থানীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আমরা এমন একটি আচরণবিধি করার কথা বলেছি, যেখানে প্রত্যেকের দায়িত্বের বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

পাহাড়ে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব

পার্বত্য জেলাগুলোতে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক পাহাড়ি ভাতা যৌক্তিক হারে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পার্বত্য জেলাগুলোর দুর্গম এলাকায় ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাহাড়ি ভাতা হিসেবে দেওয়া হলে পার্বত্য এলাকায় পদায়িত হয়ে চাকরি করতে তারা অনুপ্রাণিত হবেন। এতে পার্বত্য অঞ্চলের শূন্য পদগুলোতে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বাড়বে এবং তাদের মধ্যে বদলি হয়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

এ সংক্রান্ত অপর এক প্রস্তাবে প্রশাসনের সব পর্যায়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য রেশন সুবিধা চালুর কথা বলা হয়। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্যান্য বাহিনীর মতো যে কোনো দুর্যোগকালীন সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে থাকেন। তারা রাত-দিন নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করেন। রেশন সুবিধা দেওয়া হলে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা বাড়বে।

জন ও মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডারদের অভিন্ন বিধিমালা

জন ও মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালাসংক্রান্ত প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণীত হলে বৈষম্য দূর হবে এবং মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা বাড়বে। তাদের সামাজিক পদমর্যাদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেধা ও দক্ষতার বিকাশ ঘটবে।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একই জায়গায় আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে পৃথক এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এতে সবার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বাড়বে এবং উন্নত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি তাদের পারিবারিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সহজ হবে।

ডিসির তত্ত্বাবধানে স্থায়ী প্রসিকিউশন

জেলা পর্যায়ে আদালতে সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী প্রসিকিউশন টিম গঠনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, মামলা পরিচালনার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে পিপি, জিপিসহ অন্যান্য আইন কর্মকর্তা নিয়োগ হয়। সরকারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও পদত্যাগ করে চলে যান। নতুন সরকার এসে আবার আইন তাদের মতো করে আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। এর ফলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ প্রস্তাবের বিষয়ে একজন জেলা প্রশাসক জানান, বিগত সরকারের পতনে সারাদেশের সব আদালত থেকে সরকারের আইনজীবীরাও পালিয়ে যান। ফলে সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য কোথাও আইনজীবী পাওয়া যায়নি। নতুন করে আইন কর্মকর্তা নিয়োগের পর মামলা শুনানি ও বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছে। এতে সময়ের অপচয় হয়েছে এবং বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি বেড়েছে। স্থায়ী প্রসিকিউশন পদ্ধতি থাকলে এ পরিস্থিতি হতো না। সরকারের অন্যান্য দপ্তর কিংবা প্রতিষ্ঠানের মতো আদালতেও মামলা পরিচালনার জন্য প্রতযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে স্থায়ী আইন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা হলে মেধাবী ও যোগ্যরা নিয়োগ পাবেন। এর মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী ও সরকার লাভবান হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

পুলিশকে মারণাস্ত্রের পরিবর্তে দেওয়া হবে গোপন ক্যামেরা

পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্রের পরিবর্তে তাদের পরিধেয় পোশাকে গোপন ক্যামেরা সংযোজনের প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, পোশাকে গোপন ক্যামেরা থাকলে তাৎক্ষণিক বিষয়ে অবহিত হওয়া যাবে। দ্রুত অভিযুক্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। শিডিউল অনুযায়ী ডিউটিতে বাহিনীর উপস্থিতিরি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

মারণাস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারণাস্ত্র ও ছররা গুলি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, ছররা গুলি মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে জেলা পর্যায়ে জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমনÑ সার্কিট হাউস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয়গুলোকে কেপিআই নিরাপত্তার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে।

প্রস্তাবে নতুন কারাগার নির্মাণ না করা পর্যন্ত পুরোনো কারাগারগুলো সংস্কার করার কথা বলা হয়েছে। জেলবন্দিদের ঘুমানোর জন্য দ্বিতল শয্যাবিশিষ্ট স্টিলের খাটের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ