মাগুরার মেয়ে সাদেকা সাহানী ঊর্মি পড়ছিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। সারা দেশের মতো কোটাবিরোধী আন্দোলন যশোরেও সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু এখানে মেয়েদের তেমন অংশগ্রহণ নেই। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে তিনি তখন যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আন্দোলনে, সেই যে নামলেন, আর ফেরা হলো না বিজয় না আসা পর্যন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল বন্ধ করে দিলে মাগুরার বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হন এই তরুণী। কিন্তু সেখান থেকে প্রতিদিন যশোরে এসে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। পারিবারিক বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে সক্রিয় থাকা এই শিক্ষার্থী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বিদায় করতে পেরে তৃপ্ত।
ঊর্মির আগেই যশোরের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন শহরের বেজপাড়া এলাকার দুই বোন- জান্নাতুল ফোয়ারা অন্তরা ও জান্নাতুল ফাতেমা অনন্যা। এদের মধ্যে রাজপথে হাত ভাঙে অনন্যার, বিজয়ের ঠিক আগের দিন, ৪ আগস্ট। পরদিন ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়ে রাজপথে নামেন অনন্যা, অংশ নেন হাসিনার পতন-উৎসবে।
কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে ফ্যাসিবাদ উৎখাতের লড়াইয়ে রূপ নেওয়া জুলাই চব্বিশের এই আন্দোলনে ঊর্মি, অন্তরা, অনন্যাদের মতো হাজারো তরুণী ও তাদের মায়েদের বীরত্ব গাথা আছে। যশোরে অন্য যে কোনো আন্দোলনের চেয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল ঢের বেশি। বিশেষ করে আগস্টের শুরুতে কর্মসূচিগুলোয় মেয়েদের ঢল নামে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ছাড়াও ছিল মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরা। ৪ ও ৫ আগস্টে রাজপথে নেমে আসা নারীর সংখ্যা ৫-৭ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
এ আন্দোলনেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দেখা যায় সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের অংশগ্রহণ। চাকরির ঝুঁকি নিয়ে নেমেছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী পরিচালিত বিএএফ শাহীন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুবাইয়াৎ রাহনুমা রুবা বলছিলেন, ‘আন্দোলন চলাকালে একদিন পৌরসভায় একটি ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলাম। সেদিন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ছিল। আমি দেখলাম, পৌর পার্কের মধ্য থেকে আন্দোলনরত মেয়েরা বেরোচ্ছে। ডিবির জ্যাকেট পরা এক মোটা লোক মেয়েদের পেটাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। সন্তানতুল্য মেয়েদের রক্ষা করতে পুলিশের মুখোমুখি হই। এভাবেই কলেজ শিক্ষার্থী মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক স্বামী, ঢাবি ছাত্রী ননদের মেয়ের মতো আমিও জড়িয়ে যাই আন্দোলনে।’
শাহীন কলেজে বাংলা বিভাগের আরেক সহকারী অধ্যাপক নিলুফা ইয়াসমিনের গল্পটাও শিক্ষার্থীদের মতোই। আন্দোলনরত সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের মার খাওয়া, শহীদ হওয়া দেখে তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি। নেমে আসেন রাজপথে। আমার দেশ-এর এক প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষিকা বলছিলেন, ‘জীবনটা তো চাকরিসর্বস্ব নয়। চাকরি চলে গেলে যেত, কিন্তু অন্যায় মেনে নিয়ে চাকরি রক্ষার কোনো মানে হয় না।’
যশোরের আন্দোলনে আরেক পরিচিত মুখ অরাত্রিকা হক শ্রেষ্ঠা। যশোর শহরের মেয়ে যবিপ্রবি ম্যানেজমেন্ট শেষ সেমিস্টারের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধর মৃত্যু আমাকে অস্থির করে দেয়। এরপর থেকে প্রতিদিনই রাস্তায় ছিলাম। ঝুম বৃষ্টিতেও রাস্তা থেকে সরিনি। আমার পরিবারের সবাই এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।’
যশোরের আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ত করতে জান্নাতুল ফোয়ারা অন্তরা ও জান্নাতুল ফাতেমা অনন্যার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা সবিস্তারে বলছিলেন এই দুই বোন। অনন্যার কথায়, ৪ জুলাই রাতে যবিপ্রবিতে মিছিলের মাধ্যমে যশোরে আন্দোলন শুরু হয়। পরদিন সেখানে মানববন্ধন হয়। কিন্তু দেখা গেল আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের তেমন অংশগ্রহণ নেই। এসব দেখে আমরা দুই বোন সমন্বয়ক রাশেদ খানের সঙ্গে নেমে পড়ি মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে। দিন-রাত কাজ করেছি শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। এর ফলও মিলেছে। শেষদিকে বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী আন্দোলনের পুরোভাগে থাকত।’
অনন্যা বলেন, ‘রাশেদ খানকে কেন্দ্র করে যশোরে শিক্ষার্থীদের যে সমাবেশ ঘটে, তারা ছিল মূলত বাম ধারার বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কর্মী। পরে যুক্ত হয় ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ নানা সংগঠনের কর্মী। প্রথম থেকেই আমাদের টার্গেট ছিল স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা। যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি, সরকারি গণগ্রন্থাগারে বিকাল-সন্ধ্যায় যেসব শিক্ষার্থী পড়তে আসে, আমরা প্রথম তাদের টার্গেট করি। পরের টার্গেট ছিল ক্যাম্পাসভিত্তিক নানা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সেবামূলক সংগঠন। মনের তাগিদে এবং আমাদের সম্মিলিত তৎপরতায় এমএম কলেজ, মহিলা কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সিটি কলেজ, আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ স্কুলের শিক্ষার্থীরাও একে একে সম্পৃক্ত হতে থাকে আন্দোলনে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মেয়ে।’
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের অর্থনীতি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাজিয়া সুলতানা চাঁদনি আমার দেশকে বলছিলেন, ‘যেদিন পুলিশের মার খেয়ে ফিরলাম, সেদিন বাড়িতে গিয়েও থাপ্পড় জুটেছিল। কিন্তু দমে যাইনি, শেষ পর্যন্ত লড়েছি।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক কিশোরীও আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে চরম ঝুঁকি নিয়েছে। এদেরই একজন সায়মা জাহান জেবা। এমএম কলেজে মাত্রই উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সিনিয়রদের ওপর পুলিশ আর ছাত্রলীগের নির্যাতন হচ্ছে দেখে রাস্তায় নেমে পড়ে জেবা। অভিভাবকরা তাকে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছে বলে জানাল এই কিশোরী।
আরেক কিশোরী যশোর সরকারি মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী সিলভিয়া রেজা সারাহ বলছিল, ‘একদিন আহত হয়ে বাড়িতে ফিরেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, আজ মার খেয়েছিস, কাল পাল্টা মার দিয়ে ফিরবি।’
যবিপ্রবিতে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাদেকা সাহানী ঊর্মি। যশোর শহরে ফ্যাসিবাদবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার সূচনাও তার হাতে। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখানেই ঊর্মির নেতৃত্বে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। গোটা আন্দোলনই তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের সমন্বয়ক রাশেদ খান যশোরের আন্দোলনে নারীদের অসামান্য অবদানের কথা তুলে ধরেন। আমার দেশকে তিনি বলেন, হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এই আন্দোলনে লড়েছেন। যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকারাও। চেনা-না চেনা এসব নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া একটি গণঅভ্যুত্থান সফল হতো না বলে মনে করেন রাশেদ।