সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:০৯ অপরাহ্ন

হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর নির্দেশনা হাসিনার, অডিও ফাঁস

রিপোটারের নাম / ৬৫ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫

০৮ মার্চ ২০২৫, ১০:২৮ এএম | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১০:৩০ এএম

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ক্ষমতা ছাড়ার আগে ওই আন্দোলন দমাতে নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

 

আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের যেমন কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ছিল তার কঠোর নির্দেশনা। এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন অনেকটা প্রকাশ্যেই। তবে থামানো যায়নি সেই আন্দোলন। অবশেষে শত শত মানুষের মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে দেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা।

 

শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর একে একে বেরিয়ে আসছে তার আন্দোলন দমানোর নানা অপতৎপরতার চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি গুলি করার নির্দেশনাও দেন তিনি।

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচার গুলির একাধিক বড় অভিযান শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতে হয়েছে বলে উঠে এসেছে খোদ জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের প্রতিবেদনেও।

 

তাছাড়া কদিন পর পরই ফাঁস হচ্ছে শেখ হাসিনার অডিও কল রেকর্ড। যেগুলোতে দলীয় নেতাকর্মীদের আন্দোলন দমাতে নির্দেশ দেওয়ার তথ্য উঠে আসে।

 

এরই ধারাবাহিকতায় নতুন একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। যেখানে উঠে এসেছে আন্দোলন দমাতে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশনা’।

 

নতুন এই অডিওটি প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’। তাদের ফেসবুক পেইজে শুক্রবার (৭ মার্চ) দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ওই অডিওটি প্রকাশ করে। ওই অডিওটি এখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল।

 

তবে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার শেখ হাসিনার দেওয়া নির্দেশের অডিও’র বিষয়টি প্রথম সামনে আনেন বিশিষ্ট লেখক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ব্লগার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক পিনাকী ভট্টাচার্য।

 

গত ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে তার ব্যক্তিগত ভেরিফাইড ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। সেখানে লিখেন, ‘আকাশের হেলিকপ্টার থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র থেকে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার শেখ হাসিনার নিজের মুখে দেয়া অডিও নির্দেশ এখন আমাদের হাতে। খুনি হাসিনার ক্ষমা নাই।’

 

বলা হচ্ছে, ফাঁস হওয়া অডিওটি গত ১৯ জুলাইয়ের। যখন তুমুল আন্দোলন চলছিল ঢাকাসহ সারাদেশে। যেদিন বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওইদিনই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে জারি করা হয়েছিল কারফিউ।

ফাঁস হওয়া এই অডিওতে শোনা যায়, গোয়েন্দা সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে আন্দোলন দমাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশ দিচ্ছেন শেখ হাসিনা।

 

একজন কর্মকর্তাকে আন্দোলনকারীদের ‘ছবি দেখে রাতের মধ্যে ধরা যায় কিনা’ পরামর্শ চাইলে শেখ হাসিনা বলছিলেন, ‘ওটা না, র‌্যাব-ডিজিএফআইসহ সবাইকে (নির্দেশনার কথা) বলা হয়েছে গুলি করে মেরে ফেল।’

 

‘যেখানেই গ্যাদারিং (জমায়েত) দেখা যাবে সেখানেই উপর থেকে (হেলিকপ্টারে গুলি) করা হবে।’

 

ওই কর্মকর্তা তখন তার নির্দেশনা চাইলে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমার নির্দেশনা দেয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা এখন দিয়ে দিয়েছি।’

 

‘এখন লেথাল উইপেন (ভারী অস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে গুলি করবে।’

 

এই অডিও রেকর্ডটি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

 

অবশ্য জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। যেখানে আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচার গুলির একাধিক বড় অভিযান শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতে হয়েছে বলা হয়েছে।

 

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি করা ওই প্রতিবেদন গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক।

 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা কীভাবে একাধিক বৃহৎ আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন বিক্ষোভ দমনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্র; যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছিল।’

 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার সঙ্গে জড়িত ছিল, এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল যেখানে একদম সামনে থেকে গুলি করা হয়েছিল।’

 

জাতিসংঘ বলছে, প্রাণঘাতী ঘটনাগুলোর বিষয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্য অনুসন্ধান পরিচালনা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এ তদন্তে সহযোগিতা করেছে, প্রবেশাধিকারের অনুমতি দিয়েছে এবং নথিপত্র সরবরাহ করেছে।

 

‘সংগৃহীত সব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং মুক্তভাবে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে যে সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী আওয়ামিলীগের সাথে যুক্ত হয়ে সহিংস উপায়গুলো ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে, শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ করা হয়। নির্বিচারে আটক, এবং নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিগ্রহের ঘটনা ঘটে।’

বিভিন্ন ‘নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া’ মৃত্যুর তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে ধারণা দেওয়া হয়, ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্টের মধ্যে ১,৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী অস্ত্র, সামরিক রাইফেল এবং শটগানের গুলিতে নিহত হন।

 

এছাড়া হাজার হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হন। পুলিশ ও র‌্যাবের দেওয়া তথ্য অনুসারে ১১ হাজার ৭ শ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছিল।

 

নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু ছিল জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। শিশুরা হত্যা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পঙ্গু, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিক পরিস্থিতিতে আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের বিরূপ আচরণের শিকার।’

 

আওয়ামী লীগ সরকার সে সময় বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্রকে কীভাবে ব্যবহার করেছে, সেই বিবরণও এসেছে প্রতিবেদনে। বলা হয়, ডিজিএফআই, এনএসআই, এনটিএমসি এবং পুলিশের বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, সিটিটিটিসি প্রতিবাদকারীদের দমনের নামে সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।

 

তারা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে নজরদারির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এক সংস্থা থেকে আরেক সংস্থার সঙ্গে শেয়ার করে এবং জুলাইয়ের শেষের দিকে ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের পক্ষে প্রচার চালায়।’

 

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর একটি উড়োজাহাজে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা ভারতে পালিয়ে যান। ওইদিন প্রথমে ভারতের দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর থেকে তিনি একটানা ভারতেই রয়েছেন। মাঝে তার তৃতীয় কোনও দেশে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও তা আদৌ সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, গত সাত মাস ধরে ভারতই এখন তার ঠিকানা। এই সময়ে শেখ হাসিনার কোনও ছবি বা ভিডিও প্রকাশ্যে আসেনি।

 

এদিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দুইশতাধিক। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার তদন্তকাজ শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আগামী এপ্রিল মাসে শুরু হতে পারে। এসব কথা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ